top of page
diven world.jpg

অণুগল্প

পৃথিবী

 

কোয়েল তালুকদার

যে ভালোবাসা দূরের, যার ব‍্যপ্তি বিশ্বলোক ছাড়িয়ে অপার্থিব অন‍্য কোনো ভূবনে বিরাজ করে। সেই ভালোবাসার জন‍্য বৈরাগ্য জীবনই শ্রেয়। পার্থিব অন‍্য আর কোনো মায়ায় জড়িয়ে যেতে নেই।' এই কথা গুলো বলছিল আয়ান হায়দার। আয়ান এসেছিল লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বাংলাদেশে। যাযাবরীয় জীবন তার। এখানে সে এসেছিল কোনো সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে নিজেকে শৃঙ্খলে জড়াতে। কিন্তু করেনি। এলোমেলো জীবন যেমন ছিল তেমনই নিয়ে সে আবার ফিরে যাচ্ছে।

আয়ান চলে যাচ্ছে। আমি জানি, ওর এলোমেলো জীবন আরও বেশি অগোছালো হয়ে যাবে। দুই দিন কর্মে থাকবে তো, তিন দিন ঘুরবে ভবঘুরের মতো। বরফ পড়া শীতের রাত্রিতে কোনো পর্বতের পাশে তাঁবু টানিয়ে ক‍্যাম্প ফায়ার জ্বেলে উত্তাপ নিবে। ওর নিরুত্তাপ জীবনের উষ্ণতা খুঁজবে, তুষার পড়া রাত্রি দুপুরে।

ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল এমনি এক শীতের রাত্রিতে লস এ্যাঞ্জেলসের ডাউন টাউনে একটি কফিশপের দোতলায়। আমি ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, পদ্মা যমুনা মেঘনা পাড়ের কেউ একজন হবে। আগ বাড়িয়ে আমিই পরিচিত হয়েছিলাম। বয়সে আমার তিন চার বছরের ছোট হবে। কিন্তু আমি ওর ক্ষণিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে।

আমার সেই ক্ষণকালের প্রবাস জীবনে ওর সাথে কয়েকটি বিকেল কাটিয়েছিলাম প‍্যাসিফিকের তীরের লং বীচ, মালিবু ও সান্তা মনিকায়। এক রাত কাটিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। আর একদিন দুজনে সারারাত কাটিয়েছিলাম ডাউন টাউনের গ্র‍্যান্ড পার্কের বেঞ্চের উপরে।

মালিবু বিচের বালুকাবেলায় একদিন দুজন হাঁটছিলাম। আমাদের পিছনে ছিল পাহাড়। সামনে প‍্যাসিফিকের বিশাল জলরাশি। একদিকে নাম না জানা কতো লতাগুল্ম আর থোকা থোকা ফুলের ঝাড়, আর অন‍্যদিকে বিকালের লাল মেঘের আভা মিশ্রিত রুপালি জলের ঢেউ। কথা বলছিলাম আমরা সাগরের দিকে মুখ চেয়ে। কেন যেন মনে হলো, আয়ানের মুখ বিষন্ন মুখ ফিরে চেয়ে দেখি --  আয়ানের চোখের নীচে যেন প‍্যাসিফিকের নোনাজল। দেখলাম, মলিন হতশ্রী মুখচ্ছবি ওর। বিকালের রক্তিম সূর্যের রশ্মি সেই মুখকে একটুও রোশনি ছড়াতে পারেনি।

আমি আয়ানের পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, 'তুমি এমন একলা কেন? এখানে এই পরবাসে তোমার কেউ কী নেই? কদিনের দেখায় মনে হয়েছে, কোথায় কোন্ গভীরে, প‍্যাসিফিকের ঐ অতলান্তে তুমি তোমার অসীম কোনো দুঃখকে লুকিয়ে রেখেছ।' সেদিনের সেই নিমগ্ন সাগর বিকালে দূর হতে দমকা বাতাস বয়ে এসেছিল। আয়ানের এলমেল খুসকো চুল হাওয়া লেগে উড়ছিল। কিছুই বলতে চায়নি আয়ান, আবার বলতেও চেয়েছিল কী যেন কথা।

সেদিন মালিবু বীচের অপ্রসন্ন সেই বিকেলে কিছুই বলেনি আয়ান। বলেছিল আর একদিন ওর বাড়িতে। ওয়েল ডান কার্ণ কান্ট্রি এরিয়াতে নিরিবিলি ছোট্ট একটি রেন্ট বাড়িতে ও একাই থাকত। গ্রামীণ ছিমছাম একতলা বাড়ি। ঐদিন ঐ বাড়িতে আমি রাত্রিবাস করেছিলাম। বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটি বারান্দা ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা সেই বারান্দায় বসে কথা বলেছিলাম। অনেক কথাই সেদিন হয়েছিল।

আয়ানের বাড়ির বারান্দায় বসে সন্ধ্যায় দেখেছিলাম পিছনে একপাশে টিউলিপ ফুলের প্রান্তর, আরেক পাশে লিলি। মাঝখানে মেঠো পথের দুপাশে কার্ণেশনের ঝাড়। আমরা বসে যখন কথা বলছিলাম, তখন পিছনের প্রান্তর থেকে এইসব ফুলের গন্ধ আসছিল। রাত বেড়েই চলছিল। আয়ান আমাকে ওয়াইনের অফার করেছিল। আমি বললাম, না। শুধু সিগারেট। এ‍্যাস্ট্রেতে এক এক করে পোড়া সিগারেটের ছাই দিয়ে ভরে উঠছিল।

তখন ভালো লাগছিল ওয়েল ডান কান্ট্রির আকাশ। মনে হয়েছিল এ যেন বাংলাদেশের আকাশ! এ যেন আমাদের কুসুমপুরের তারাভরা রাত্রি। মাঝে মাঝে হিম প্রবাহ বয়ে আসছিল দূরের সান গ্যাব্রিয়েল মাউন্টেন থেকে। সেদিন তারার আকাশে কোনো কথা ছিল না।  টিউলিপ ঝাড়ে কোনো জোনাকির গান নেই। বাতাসের কোনো শব্দ নেই। নিশ্চুপ ছিল নির্জন বিজন রাত। কী এক বিষাদ ছড়িয়ে সেদিন সেই রাতে আয়ান হায়দার বলেছিল তার কথা।

খুব সংক্ষেপিত করে আয়ানের মুখ থেকেই সে কথা শুনি:

মেয়েটির নাম ক‍্যাথেরিন রিচি। আমি ওকে ডাকতাম রিচি বলে। ও এসেছিল ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে। রিচি ছিল একজন স্ট্রিপ গার্ল। প‍্যাসাডোনার নাইট ক্লাব ক্রেইক এ‍্যাভিনে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। নীল ঝলমলে আলোর নীচে আমি ওর বাঙালি মেয়েদের মতো কালো চোখ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম।  ওর ঐ চোখ দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। প্রথম কথা ছিল, 'তুমি কে? কোথা থেকে তুমি এসেছ। তোমার নাম কী?' তারপর বলেছিলাম, 'তোমার কথা কিছু বলো।' রিচি বলেছিল --  I am Katherine Ricci , came from Reo de Jenerio, Brazil. I am no bird, and no net ensnares me, I am a free human being with an independent will.'

রিচির কোনো ঘর ছিল না। পাখির বাসার মতো আশ্রম ছিল না। কিন্তু, সেই মেয়ে পাখির মতো নীল আকাশে উড়ত। রিচি বলেছিল -- 'আমি ধূসর কালো মেঘ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জলে ভিজি। রঙিন জলসায় পিয়ানো'র সুরে আমার অন্তরে বীণা বাজে। আমার দুঃখ নেই। আমার সমস্ত বেদনা সুখ হয়ে যায় মুহূর্তে  সব নৈশ ক্লাবের আনন্দে।'

আয়ান একের পর এক সিগারেট শেষ করছিল। আমি বললাম, 'তারপর কী হলো? ঐ মেয়েকে তুমি কী ভালোবেসে ফেলেছিলে?'

 

আয়ান :  জীবনের দুঃখতম নিয়তি ঈশ্বর মনে হয় নির্ধারিত করে রেখেছিল আমার জন্য। যে পাখির বাসা নেই। তার বাসা পৃথিবী জুড়ে নীল আকাশ। আমি রিচিকে এই ঘরে এনেছিলাম, বলেছিলাম-- এই ঘর তোমার। এখানেই তুমি তোমার সংসার বাঁধো। তোমাকে সন্তান দিব।

রিচির চোখ সত্যি বাঙালি। শাড়ি পরিয়েছিলাম ওকে বিয়ের রাত্রিতে। কী সৌভাগ্য! বাসর শয‍্যায় ওর ভ্রূণ তৈরি হলো। এক অনাগতের স্পন্দন ধ্বনি সেই রাতেই শোনা গেল।

আয়ান একের পর এক সিগারেট টেনেই যাচ্ছিল। কথা বলতে যেয়ে থেমে থেমে যাচ্ছিল বার বার। আমি বললাম -- তারপর ?

আয়ান : আমাদের সেই সন্তানটির পৃথিবীতে চলে আসবার দিন ক্ষণ খুব কাছাকাছি চলে আসতে থাকে। উইলশেয়ার বেলেভার্ডের সামারিতান হাসপাতালে রিচির  একটি চেকআপ ছিল। ডাঃ লী জয়নার ওকে হাসপাতালে  ভর্তি করে নেয়।

আয়ান আমাকে বলছিল, তুমি কী গান গাইতে পারো রঞ্জন? আমি বলেছিলাম -- ভালো পারি না।

--- তবুও শোনাও।

--- কী গান গাইব, বলো?

--- রবীন্দ্রনাথের গান।

--- কোন্ গানটি গাইব?

--- জীবন যখন শুকিয়ে যায়।

--- আচ্ছা, গাইছি।

 

অন্তরা পর্যন্ত গানটি আমি সেই দিন আয়ানকে গেয়ে শোনায়েছিলাম। শেষটুকু আর গাওয়া হয়নি। রাত তখন অনেক হয়ে গিয়েছিল। হিম বাতাস বয়ে আসছিল প্রবলবেগে। মনে হচ্ছিল, কার্নেশন, আর টিউলিপ ঝাড়ে জলের মতো বিন্দু বিন্দু করে তুষার ঝরে পড়ছে।

আমি আয়ান হায়দারকে বলি -- তারপর?

আয়ান : একদিন হাস্পাতালের বেডে শুয়ে থেকে রিচি আমাকে বলেছিল --- যদি দূরে চলে যাই। জীবনের ওপাড়ে যদি অন‍্য কোনো ভূবন থাকে, সেই ভূবনেও তুমি এসো।

কতো প্রহর, কতো ক্লান্তিতে পথ ধরে হাঁটছি। আকুল হয়ে অপেক্ষায় আছি ওর ভুবনে পৌঁছার। কিন্তু ওর সেই ভুবন ওর সেই পৃথিবী যে অনেক দূর!

 

fbegum.jpg

অণুগল্প

গল্প নয় কাহিনি

ফিরোজা বেগম

 

আয়েশারা চার বোন।  প্রত্যেকটা বোন দেখতে অসম্ভব সুন্দরী। কাছে বসে দেখলে মনে হয় "চকোরী" ছবির নায়িকা সেই ছোট্ট শাবানাকে দেখছি। তবে শাবানার চোখ ছোট আর চার বোনের চোখ যেনো টানা টানা কাজলনয়না । গায়ের রঙ দুধে হলুদে মিশ্রণে।  জোড়া ভ্রু, গোলাপ পাপড়ি ভেজা ঠোঁট। এহেন রূপের অধিকারীনিরা আবার মেধা ও মননে সবার সামনে। স্কুলে  ভালো ছাত্রী হিসেবে বেশ পরিচিতা। গুণেও সবাইকে ছাড়িয়ে । বড়ো বোন রাইসা লেটার নিয়ে এস এস সি,এইচ এস সি পাশ করে ইউনিভার্সিটিতেও প্রথম শ্রেনী হাতে নিয়ে সাথে সাথেই শিক্ষা বিসিএস দিয়ে শিক্ষকতার মহান পেশাটি বেছে নিলো। সাথে সাথে ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষকের সাথেই বৈবাহিক গাঁটছড়া বাঁধলো। এ যেনো পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার নিয়ে গেলো সুন্দরী রাজকুমারীকে। সুয়োরাণী হয়ে সামলাচ্ছে তার সাজানো সংসার। রয়ে গেলো মেজো রাজকুমারী।

মেজো রাজকুমারী আয়েশা ! রূপে গুণে শিক্ষায় বড়োকে আরো একধাপ ছাড়িয়ে গেলো। আয়েশা লেখাপড়ায় ক্লাশে তুখর ছাত্রী। প্রতিটি ক্লাশে প্রথম স্থানটি কেড়ে নিয়ে এস এস সি তে সর্বাধিক নাম্বার পেয়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে এইচ,এস,সিতে ভর্তি হয়। হোষ্টেলে থেকে পড়াশোনার সময় ভাগ্য বিড়ম্বনা করলো  আয়েশার সাথে। ওর এতো সাফল্য রূপ আকৃষ্ট করলো সম্পর্কে না যাওয়া দেখতে সুন্দর এক যুবক আত্মীয় শাহীনকে।  জড়িয়ে পড়লো অসম প্রেমে। এর বেলায় বোধহয় দুয়োরাণী  শব্দটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।  যুক্ত হতে থাকলো " অতি সুন্দরী না পায় বর আর অতি ঘরণী না পায় ঘর! " ওদের এই প্রেম মা বাবা আত্মীয় স্বজন কেউ মেনে নিতে পারলোনা। একদিন ওরা দু'জন কাজীর অফিসে গিয়ে বিয়ে করে সকলকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলো। চোখের জলের বিনিময় যে সুখি  হওয়া যায়না আমাদের দুয়োরাণী তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে দিলো।

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুয়োরাণী আয়েশা মা হতে চললো। ব্রজমোহন কলেজের পাঠ চুকিয়ে বুকিয়ে শ্বশুর বাড়ির কাছাকাছি সরকারি কলেজে ভর্ত্তি হয়ে মাঝে মাঝে ক্লাশ করতে থাকলো। কলেজ, শ্বশুরবাড়ি, স্বামীর দেখভাল করা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হলো। অপরদিকে প্রেগন্যান্সির কারণে নিজের শরীরটাও খুব দুর্বল লাগছিলো আয়েশার। যখন এমন কষ্টকর অবস্থা একদিন লুকিয়ে দ্বারস্থ হলো ওদের পারিবারিক পুরনো  ভৃত্যের কাছে। তার একটি কিশোরী মেয়েকে কাজে সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানালো।  পুরোনো ভৃত্য কোনো বাক্যব্যয় না করে তার মেয়েকে দিয়ে গেলো আয়েশার কাছে। মেয়েটি  ভালোই দেখাশোনা করতে থাকে।  রাতে মেয়েটিকে আয়েশা নিজে পড়ায়।  ভাবে একটি মেয়ে যদি দারিদ্র‍্যতাকে  জয় করে নিজের একটা সম্মানজনক পরিচিতি বানিয়ে নিতে পারে, ক্ষতি কি ?

 

যথাসময় আয়েশার কোলজুড়ে ফুটফুটে  আর এক রাজ কুমারের আবির্ভাব হলো। কিন্তু ; নানা- নানীর কোনো আদর আপ্যায়ন থেকে বঞ্চিত রয়ে গেলো। আয়েশার স্বামী বেকার। বাধ্য হয়ে নিজের ও সন্তানের ব্যয় মেটানোর জন্য বাড়িতেই বেশ কয়েকটি মেয়েকে টিউশানি পড়াতে থাকলো।  তাতে করে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতে থাকে। আয়েশা স্বামী শাহীনকে উৎসাহ যোগাতে থাকে কোনো কাজের জন্য। কিন্তু অলসতা যেনো তার জীবনের ব্রত। এমনি পরিশ্রম ও সংগ্রাম করে  প্রেমের খেসারত দিয়ে যাচ্ছিলো আয়েশা ।এদিকে পড়ার চাপ বেড়ে গেলো।  সামনে অনার্স ফাইনাল। তবুও টিউশানিকে ছাড়ছেনা। ওটা ছাড়লে চলবে কী করে? দেখতে দেখতে পরীক্ষা  শুরু হয়ে গেলো। আয়েশা ছেলেকে মুকুলী ও শ্বাশুরীর কাছে রেখে সকালে পরীক্ষা দিতে যায় সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই একদিন বাসায় ফিরে দেখে মুকুলীকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সবাই খোঁজ খবর করছে। ওর বাবার কাছে মোবাইল করে জানতে পারে ওখানেও যায়নি। মহাবিপদে পড়লো গোটা পরিবার। স্বামীকে পাঠালো জানাশোনা কোথাও খোঁজ খবর নিতে। কোনো ছেলের সাথে প্রেম ছিলো কিনা এমন সব ভাবতে ভাবতে দুদিন পর শাহীন মুকুলীকে সাথে নিয়ে ফিরলো।  সকলের প্রশ্ন কোথায় গিয়েছিলো মুকুলী ? কোথায় পেলে? ইত্যাদি!  কিন্তু; শাহীন কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো।  মুকুলী ওড়নার আঁচলের এক কোণা মুখে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে  রইলো। আয়েশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো সাঁই সাঁই করে দুটো চড় কষিয়ে দিলো গালে।  সাথে সাথে ফুঁসে উঠলো মুকুলী, " খবরদার! আর একটা চড়ও দিবেনা আমায়। এবার আপনি থেকে তুমিতে চলে গেলো, তোমার এই সংসারে  যে অধিকার, আমারও সেই একই অধিকার! " আয়েশা স্তব্ধ হয়ে গেলো।  ধীর গতিতে রুমে ঢুকে শাহীনের সামনে দাঁড়ালো। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, " মুকুলী এসব কী বলছে?  কেনো বলছে?  এর জবাব দাও ! শাহীন নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয়, "তুমি তো একজন নারী বুঝতে পারছোনা? মুকুলী ঠিকই বলেছে। আমি মুকুলীকে ভালোবাসি। আয়েশার চোখে তিনটি বছরের ফেলে আসা অপমান,ব্যথা ও যাতনার দিনগুলো চোখের সামনে দ্রুতগতিতে ভেসে উঠলো আবার মিলিয়ে গেলো। চারিপাশে শুধু ধূ ধূ মরুভূমি দেখতে থাকে। কোথায় যাবে আয়েশা ছেলেকে নিয়ে। মা বাবা কি এই মুহূর্তে পাশে থাকবে? হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শাহীনের মু্খোমুখি হয়। তারপর শ্বশুর শ্বাশুরীর সামনেই শাহীনকেও শক্ত হাতে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে, "ভালোবাসা? আরে ভালোবাসার তুই কী বুঝিস? তুই তো আস্ত একটা চরিত্রহীন কা-পুরুষ! " এই বলে এক কাপড়ে ছেলের জামাকাপড় নিয়ে বের হয়ে আসে। 

 

আয়েশার দু'চোখে অন্ধকার নেমে আসে।  কোথায় যাবে ? কার কাছে গিয়ে দু'চোখের অশ্রু ঝরাবে। শ্বশুর শ্বাশুরী অবশ্য আয়েশার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দিলেন।  কিন্তু ; আয়েশা নির্বিকার।  চোখদুটো জ্বালা করছে।  কাঁদতে পারলে হয়তো একটু শান্ত হতো। কান্নারা কোথায় পালালো এই মুহূর্তে ? ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিলো। রাতটা কাটতে না কাটতেই ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বড়ো খালার বাসায় গিয়ে উঠলো। সেখান থেকেই এতো প্রতিকূলতার মধ্যে পরীক্ষা শেষ করলো। আর টিউশানি চালিয়ে মা ও ছেলের জীবন যাপন করতে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা দিয়েছিলো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার কিছুদিন পরই নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল পেলো। তাতে আয়েশা সর্বপ্রথম হয়েছে।  যথারীতি মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে চাকুরিতে যোগদান করলো। স্বামী পরিত্যাক্তা ও বয়স বিবেচনায়  নিয়োগ কমিটি ওকে শহরের মধ্যেই একটি স্কুলে সহঃ শিক্ষিকা পদে নিয়োজিত করলো।

আয়েশার খালার বাসায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে একদিকে চাকুরি অন্যদিকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে থাকলো। পাশাপাশি বিসিএস গাইড কিনে নিয়মিত  পড়তে থাকে। অনার্স এর ফল বেড়োলো প্রথম বিভাগে প্রথম। আশার আলো চোখের তারায় চিকচিক করে উঠলো। পূর্ণ উদ্যমে আবার পড়াশুনা শুরু করলো আয়েশা। এবারে মাস্টার্স। তাতেও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলো।  মাঝখানে বিসিএস( ক্যাডার ) প্রিলিমিনারি দিয়ে লিখিত পরীক্ষার দিন গুনছে আয়েশা।

 

আয়েশার চোখে রাতে ঘুম নেই। জেগে জেগে আগামী সাফল্যতার স্বপ্নে বিভোর থাকে আর দিনে তার সংগ্রাম চলে। সুন্দরী রূপসী সেই আয়েশাকে আর চেনা যায়না। গায়ের রঙ মলিন,মুখের হাসি বিলীন, পেটে ক্ষুধা, সমাজের কাছে লজ্জার জবাবদিহিতা করতে করতে যখন ক্লান্ত ঠিক সেই সময় বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হাজির। প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসে ঢাকায় এসে পরীক্ষা দিলো। আয়েশার মনে হলো ইশ্বর সয়ং ওর কলমটা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র যেনো ওর কতোদিনের জানাশুনা। পরীক্ষার হল থেকে বেড়িয়ে আয়েশার মনে হলো নতুন এক সূর্য পূব আকাশ রাঙিয়ে উঁকি দিচ্ছে শুধু ওরই জন্য।

আজ সাত বছর হয়ে গেলো আয়েশা ১ম শ্রেণীর একজন বিসিএস ( প্রশাসন) এর কর্মকর্তা। সে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদমর্যাদায় চাকুরি করছে সাফল্যের সাথে। এর মধ্যে সহকারী কমিশনার, আরডিসি, সহকারী কমিশনার (ভূমি )'র দায়িত্ব পালন করে সচিবালয়ে কর্মরত আছে। এখন বাবা মা আত্মীয় স্বজন সবাই প্রশংসায় মুখর আয়েশার। সবাই খোঁজ খবর রাখছে। 

এদিকে শাহীনকে ছেড়ে মুকুলী চলে গেছে এক রিক্সাওয়ালার হাত ধরে। ওখানে বিয়ে করেছে । শাহীন বাবা মাকে নিয়ে গিয়েছিলো আয়েশার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা পাওয়ার জন্য। কিন্তু ; আয়েশা তার প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্তে অটল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে শাহীন ও শ্বশুর শাশুড়িকে। আয়েশার ছেলে রাকিন ঢাকার নামকরা একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। 

 

আয়েশা এখন রূপে,গুণে, সাফল্যে সমাজে উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ছয়মাস আগে আয়েশার অফিসের সিনিয়র যারা,সবাই মিলে বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের পাত্র যদিও বিপত্নীক। প্রথম সন্তানের জন্মদিতে গিয়ে তিন বছর আগে স্ত্রী মারা যান। সতঃস্ফুর্ত ভাবে আয়েশার ছেলের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তিনি নিজেও বিসিএস ( প্রশাসন) এর যুগ্ম-সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। সবদিক বিবেচনায় এই বিয়েকে স্বাগত জানান সর্বস্তরের মানুষ।

 

 

শিক্ষনীয়ঃ নারী শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষার ফল খুবই মধুর। নারী সন্তানের জন্য ধৈর্য ও আত্মত্যাগের প্রতীক!

AB STORY.jpg

অণুগল্প

 

 

চাপাও ওস্তাদ, চাপাও

 

আবদুল বাতেন

কে একজন আসাদের হাতঘড়িটা খুব দ্রুত খুলে নেয়। ওমিগা ব্রান্ডের ঘড়িটা তাঁর খুব প্রিয়, সুইডেন থেকে বন্ধু মিঠুর পাঠানো। সে প্রাণপণে চোখ খোলার চেষ্টা করে।কিন্তু কোনভাবে খুলতে পারেনা।কে যেন তাঁর দু’চোখের পাতা সেলাই করে দিয়েছে। কিংবা তাঁর দু’চোখে আস্ত যুগল পাহাড় বসিয়ে রেখেছে।ঘড়িটা পকেটে রেখে লোকটা আসাদের ওয়েডিং রিংটা খোলার জন্য উঠে পড়ে লাগে।একবার ডানে আরেকবার বায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেনেটুনে বের করার নানা কসরত চালিয়ে যায়।আসাদের ভেতরটা ভেঙেচুরে যেতে থাকে।তাঁর শিরা উপশিরাগুলো পটাপট ছিঁড়তে থাকে।সে লোকটার পায়ে পড়ে বলতে চায় -প্লিজ, ওটা নেবেন না।ওটা আমার ওয়েডিং রিং, আমার বেহেস্তবাসী শ্বাশুড়িমার দেয়া প্রথম উপহার। কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে কোন অথপূর্ণ শব্দ বের হয়না। শুধু সামান্য অস্পষ্ট চিনচিন আওয়াজ ওঠে, পুকুরজলের বুদ্বুদ যেনবা। আসাদের মাথার ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরে। থুতনিটা তাঁর মুখের সাথে ঝুঁলে আছে, মনে হয়। জিভে বড় নোনতা নোনতা ঠেকে।দাঁতের অস্তিত্ব টের পায়না, সে।ডান পাটা ভয়ানক কনকন করে, কিন্তু নড়াতে পারেনা।একসময় খেয়াল করে, হাঁটু থেকে তাঁর বাঁ পাটা উধাও! সত্যি কি নেই? কেন ওটার অস্তিত্ব সে অনুভব করছেনা? দুমড়েমুচড়ে থাকা আসাদকে ঘিরে কয়েকটা মাছি উড়ে।ভনভন শব্দ হয়।উড়ে উড়ে একটা তাঁর নাকে বসে।নাকটা শিরশির করে চুলকায়।মাছিটাকে তাঁর লোকটার মত বদমাস বদমাস লাগে। লাল কি কালো পিঁপড়া তাঁর হাত বেয়ে উঠে। সে হাত নড়াতে চড়াতে পারেনা। হাত সরাবার সামান্য শক্তিও তাঁর আর অবশিষ্ট নেই। সে নিশ্চয় এখনো বেঁচে আছে। ধীর শ্বাসপ্রশ্বাসে তাঁর বুক উঠানামা করছে।যে বুকে আসাদ তাঁর মা, মেয়ে আর প্রিয়তমা স্ত্রীকে সযতনে রেখেছে। মানুষ মরে গেলে কি এতসব বুঝতে পারে? নিশ্চয় পারেনা।তাঁদের কোচটা ঠিকমত চলছিল, রাতের আঁধার চিরেফেঁড়ে।ইসলামি ওয়াজ ও সংগীতের ছোঁয়ায় ঝিমাচ্ছিল, নাইট কোচের সবাই। কায্বা নামায আদায় করছিল, মুরব্বীরা কেউ কেউ।আতরের সুঘ্রাণে ভেসে যাচ্ছিল আশেপাশের সিটসমূহ।আবার বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষে লতাজীর স্নিগ্ধ সুরের মূর্ছনায় সব ভিজে একাকার। অফিসের জরুরি কাজে দিনাজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিল, আসাদ।অনেকক্ষণ ধরে পিছনের কোচটা হর্ণ চাপিয়ে যাচ্ছিল, একনাগাড়ে।দুম করে সেটা তাঁদেরকে ওভার টেক করতে গেলে যাত্রীদের কেউ কেউ গা ঝারা দিয়ে ওঠে। সমস্বরে বাহাদুরি ফলাতে শুরু করে -চাপাও ওস্তাদ, চাপাও। ড্রাইভার সেই যে চাপাল, আসাদের আর কিছু মনে নেই।একটু একটু করে তাঁর কানে কোলাহল জড়ো হতে থাকে।কান্নাকাটির শব্দ তাঁকে আস্তে আস্তে জাগিয়ে তোলে। সে এখন তাঁর কাছাকাছি এ্যামবুলেন্সের সাইরেনে শিহরিত হয়। ভারী ভারী পায়ের আওয়াজে ভীষণ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

bottom of page