রাজাকার কাহিনী
সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো আলির চিৎকারে।
সে তার রুমের ভেতরই চিৎকার করছে।
আমরা রেস্টুরেন্টের উপরের ফ্লাটে একেক রুমে-দু’জন করে থাকি।আলি আর আমার রুম পাশাপাশি।স্বাভাবিক ভাবে কথা বললে এক রুমের আওয়াজ আরেক রুম থেকে শোনা যায় না।তবে জোরে জোরে কথা বললে পরিস্কার শোনা যায়।আর চিৎকার করলে তো কথাই নাই।
আলির চিৎকারের ভলিয়্যুম আরো বাড়লে আমি রাগান্বিত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে তার রুমের দরোজা খুললাম।
সে বিছানায় আধ শোয়া হয়ে চিৎকার করছে।কাকে যেনো গালাগালি করছে।নানান ধরণের গালাগালের এক পর্যায়ে ‘রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার’ বলে মোবাইলটাকে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দরোজায়-আমার দিকে তাকালো।তার চোখ দু’টি লাল হয়ে আছে।
বললো,
- তোমার কি সমস্যা?
চড়া ভলিয়্যুমেই প্রশ্ন করলো।
বললাম,
- তোর চিৎকারে আমি ঘুমাতে পারছি না,এটাই আমার সমস্যা।
- ঘুমাতে না পারলে জেগে বসে থাকো।কমপ্লেইন করতে এসেছো কেন?তোমার জন্য ফোনেও কথা বলতে পারবো না?
উদ্ধত আলির কথা বলার ভঙ্গিটাই এখন ঝগড়াটে।ফোনে যে ঝগড়াটা করছিলো-সেটির রেশ তার এখনো কাটেনি।তার চিৎকারে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা আমারো চট করে মাথায় রাগ উঠে গেলো।তবে আমি নিজের রাগটাকে কন্ট্রোলে রেখে শান্ত ভাবে বললাম,
- ফোনে কথা বলতে, না তো করিনি আলি।চিৎকার করার কথা বলছি।চিৎকার যদি করতেই হয় নিচে গিয়ে ইচ্ছা মতো কর।
- আমি এখানে,আমার রুমেই চিৎকার করবো।তোমার ঘুমের সমস্যা হলে তুমি নিচে গিয়ে রেস্টুরেন্টের সোফায় ঘুমাও।
বলে কি,ব্যাটা ফাজিল!
সোফায় ঘুমাবো গিয়ে আমি!
আমার রাগ আরো চড়লো।তবে নিজেকে আবারো আমি কন্ট্রোলে রাখলাম।
পরবর্তী যে কথা এখন আমি বলবো,এতে এর সাথে আমার মারামারি লেগে যাবে।এই সকাল বেলা মারামারি করার কোন ইচ্ছা আমার না থাকায় কিছু না বলে আমি আমার রুমে এসে ফের ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
অবশ্য বিকাল চারটার কিছু পরে,মারামারি হলো একটা-রেস্টুরেন্টে।তবে সেটি আমার আর আলির মাঝে নয়।মারামারি হলো আলি আর আমাদের শেফ রব্বানী মিয়ার মাঝে।
ঘটনাস্থলে আমি উপস্থিত না থাকার কারনে পুরো ঘটনাই শুনতে হলো আমার কলিগ ফুল মিয়ার কাছ থেকে।
ঘটনা এ রকমঃ
চারটার দিকে কিচেনের সবাই যার যার কাজ করছিলো।
এক সময় শেফ রব্বানী বললো,
- ডিসেম্বর আসলেই কি যে এক অবস্থা শুরু হয় আমাদের বাঙালিদের মাঝে,ইয়া মাবুদ।ফেইস বুক টেইস বুক খোলা ই যায় না।এক শ্রেণির লোকরা বুঝুক অথবা না ই বুঝুক,মুক্তিযুদ্ধ,বিজয় দিবস,স্বাধীনতা,আওয়ামীলিগ,শেখ মুজিব করে করে অস্থির হয়ে ওঠে।
কিচেন পোর্টার চাচা,শেফের কোন কথাতেই কখনো দ্বিমত পোষন করেন না।তখনো করলেন না।তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
- একদম ঠিক কইছো রে বাবা।আইজ কাইলকার ছেলে পুলেরা কি জানে,কি বুঝে?না বুইঝাই ফালাফালি করে।
- আপনি রাইট চাচা।ওগুলারে ধরে ধরে প্যাদানী দিলে বুঝতে পারতো স্বাধীনতা মানে কি। আর আমরাও দেখতাম তাদের শেখ মুজিব বাপে কবর থেকে উঠে এসে তাদের বাঁচায় কি ভাবে?
পোর্টার চাচা সহ কিচেনের বাকী দু’জনও হো হো করে হেসে উঠলো।
তখন আলি বলে উঠলো,
- রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার।
আমি চমকে উঠে ফুল মিয়াকে বললাম,
- আজ সকালে ও ফোনে আলি কাকে যেনো ঐ গালিটাই দিয়েছিলো।
ফুল মিয়া হাসলো।
- সেটা তার দেশের পার্টনারকে।
- দেশে তার পার্টনার মানে?
- এ কি বাবর ভাই!তুমি আলির গুড়ের ব্যাবসার কথা ভুলে গেছো?
সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম।বয়স হয়ে গেছে-কতো কিছু আর মনে রাখবো!
গুড়ের কথায় আমার মনে পড়লো।বললাম,
- মনে আছে,মনে আছে,মরচা গুড়ের ব্যাবসা।মামাতো ভাইয়ের সাথে তার পার্টনারশীপ ব্যাবসা।
- হ্যাঁ সেটাই।তার সেই পার্টনার নাকি এক বছর ধরে তাকে সঠিক মতো হিসাব দেয় না।ব্যাবসার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে সে কিছু জানে না।কর্মচারি পোলা পাইন জানে।
- এ আবার কি রকম কথা?
- বাদ দাও বাবর ভাই সেসব কথা।আজকেরটা শোনো,গাভনার সাব বলেছেন,এ ঘটনার মীমাংসা তোমাকেই করে দিতে হবে।
- হুম,বলো।আলি গালি দেবার পর কি হলো?
- গালি দেবার পর রব্বানী,আলি কে জিজ্ঞাসা করলো’রাজাকারের বাচ্চা বলে তুমি গালিটা কি আমাকে দিলে’?আলি বললো’হ্যাঁ’।রব্বানী তেড়ে গিয়ে বললো’আবার গালিটা দে’।আলি আবারো বললো’রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার’।ব্যাস,লেগে গেলো ঘুষাঘুষি।আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে দুইটাকে সরিয়ে না নিলে আজ নির্ঘাৎ একটা মার্ডার হয়ে যেতো।দুইটাই ভীষণ ক্ষেপে ছিলো।
-হুম।মার খেয়ছে কে বেশি?
- শেফ রব্বানী।
ফুল মিয়া হাসলো।
আমি বললাম,
- ভালো হয়েছে,বেশ ভালো হয়েছে।ঐ ব্যাটা শেফ প্রায় সময়ই দেখেছি বাংলাদেশ,মুক্তিযুদ্ধ,শেখ মুজিব এই সব বিষয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করে।দু’এক বার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমার সাথেও তার ঝগড়া হয়েছে,তোমরা তো জানোই।আর ক্রীকেট খেলার বিষয় নিয়ে তার সাথে তো হর হামেশাই আমার বাক বিতন্ডা হয়।শুধু মাত্র গাভনারের মুখ চেয়ে,ব্যাবসার খাতিরে আমি আর কোন এ্যাকশানে এমনকি পারতপক্ষে ঐ ব্যাটার সাথে কথাও বলি না।
- তা তো জানি।
- আজ আলি তাকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে।
- হ্যাঁ,সেটাই।
- গাভনার সাব যখন বলেছেন,আমিও আজ বিচার করবো,কঠিন বিচার।
আজকের দিনটা আমার শুরু হয়েছিলো-আলির সাথে রাগারাগি করে,বাজে ভাবে।ঘুম না হওয়ার কারনে মাথার মাঝে এক ধরণের ভোঁতা যন্ত্রণা ছিলো সারাক্ষণ।আলির প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ছিলাম এতোক্ষণ।
ফুল মিয়ার মুখে আলির মারামারির ঘটনা শোনার পর,আমার সব রাগ,সব ক্ষোভ মুহুর্তে উধাও হয়ে গেলো।মাথার ভোঁতা যন্ত্রণা হঠাৎই মিলিয়ে গেলো।আশ্চর্য এক আরামের আবেশে মগ্ন হয়ে আলিকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।
コメント