top of page

এই সপ্তাহের গল্প: রুকসানা হক



অপঘাতক


হুজুর পাঞ্জাবিটা কোমরে পেঁচিয়ে গিট্টু দিলেন। হাতে ছোরা নিয়ে প্রস্তুত হলেন গরুটাকে জবাইয়ের জন্য।

ঈদের সকাল মানে হুজুরের ব্যস্ততা।

সারা বছরে একবার এই সুযোগ আসে। পশু জবাইয়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহ পাকের দিদার লাভের মোক্ষম সুযোগ। তিনি এবাড়ি থেকে ওবাড়ি খুব দ্রুতগতিতে কর্ম সম্পাদন করার চেষ্টা করেন। সবাই পশু নিয়ে প্রস্তুত থাকে, হুজুরের অপেক্ষায় থাকে।


নসু মাতব্বরের বাড়ি আসতে হয় ঈদের নামাজ শেষেই। ওখানে এলাকার সব থেকে বড় পশুটি কোরবানি করা হয়। কিন্তু কেউ জানতেও পারে না তার চেয়ে শতগুন বড় হাজারটা পশু রয়েছে মানুষের ভেতরে। আর ভেতরের পশুকে কোরবানি দেয়া কোন সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।

অদৃশ্য কোন রক্তিম চোখ ভেতরের এই পশুগুলোকে কড়া পাহারায় রাখে। ওগুলো কাউকেই দেখতে দেয়া হয় না। হুজুরকে তো নয়ই। নসুর ভেতরের পশুও অক্ষত অবস্থায় তার ভেতরেই চুপ করে বসে আছে।

হুজুরের অবশ্য এসব দেখতে নেই জানতেও নেই। তিনি কোমরে লম্বা আলখেল্লাটা কিভাবে বেঁধে রাখবেন সেটুক পর্যন্তই ভাবতে পারেন। উশৃংখল এই বড় গরুকে কয়েকজন লোক দড়ি দিয়ে বেঁধে অদ্ভুত কৌশলে মাটিতে শুইয়ে দিলো। এসব কৌশল কেবল মানুষই জানে।


মানুষের অসাধ্য যেন কিছুই নেই। নাহয় এতো।বড় একটা জন্তুকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

সবাই মিলে মাথা ও পা চেপে ধরলো। গরুটির নড়ারও সুযোগ রইলো না। সে কেবল গোঁস গোঁস শব্দ তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল।

হুজুর আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালালেন। ঠিক তখুনি ঘটলো ভয়ঙ্কর বিপত্তি। শক্তিমান গরুটি পায়ের দড়ি ছিঁড়ে সবাইকে ধাক্কা মেরে দিলো দৌড়। গলা দিয়ে রক্ত ঝরছে। আধখানা গলা কাটা গরুটির। ছোরা হাতে ভয়ার্ত হুজুর গড়িয়ে পড়লেন একপাশে। গরুর খুরের চাপায় আহত হলো দু'একজন। হুজুর একটানা পড়তে লাগলেন, " লা হাওলা ওলা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম।" গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না যেন। স্বরতন্ত্র চেপে বসে ছিল মাতব্বরের ভেতরের পশুটা। নসু মাতব্বর চিৎকার করে উঠলো। " গাধার বাচ্চারা কিভাবে গরুকে ধরলি যে গরু উঠে পালিয়ে গেলো। "


কয়েকজন গরুর পিছু ধাওয়া করলেও কোনভাবেই ওকে ধরতে পারলো না। লাফিয়ে লাফিয়ে বড় দীঘির পাড় ছাড়িয়ে পরিত্যক্ত জমিতে নেমে গেলো গরু। রক্তের বন্যা যেন বয়ে চলছে পথে। তার গলার গোঁস গোঁস শব্দ আরো প্রবল হলো। জমির শেষ মাথায় হাজার বছরের পুরোনো রাজবাড়ির মন্দির। ভুতুড়ে অন্ধকার জায়গা। পারতপক্ষে মানুষজন ওপথ দিয়ে যাওয়া আসা করে না।

এই মন্দিরকে ঘিরে অনেক লোককাহিনী প্রচলিত আছে। ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক কাহিনী। বাহির থেকে মন্দিরের অবস্থান চিহ্নিত করা সহজ নয়। উঁচু আগাছা, তেতুল গাছ, গুলাল গাছ মন্দিরের চূড়াটাকেও আপাদমস্তক ঢেকে রেখেছে। দিনেরবেলাও ওখানে সূর্যালোক প্রবেশের উপায় নেই।

গরুটি সেই পুরোনো মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিলো। কিন্তু কারো সাহস নেই ওখানে যাওয়ার। এমনকি জমিটা পার হবারও সাহস কারো নেই। নসু মাতব্বর আবার চিৎকার করে গালাগাল শুরু করলে অতি সাহসী ফয়জুল্লাহ ভেতরে যেতে রাজি হলো।

টগবগে যুবক ফয়জুল্লাহ।

গায়েগতরে পালোয়ান। বুদ্ধি কম হলেও প্রভুভক্ত সে। নসুর খাস চাকর। খুব বেশিদিন হয়নি ফয়জুল্লাহ নসুর বাড়িতে চাকরী নিয়েছে। এই অল্প দিনেই মাতবরের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে সে। ফয়জুল্লাহ একা গরু সামলাতে পারবে না বলে সাথে লোকজন চাচ্ছে। কিন্তু প্রাণের মায়া কেউ ত্যাগ করতে রাজি নয়। মন্দিরে ঢুকলে কেউ জীবিত ফিরে আসবে না এমনি ধারণা প্রচলিত। নসু মোটা অংকের টাকা দেবে বলে ঘোষণা দিতেই লোভে পড়ে চার-পাঁচজন ফয়জুল্লাহের সাথে গিয়ে গরুকে কোনমতে বাগে আনলো। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে ততক্ষণে পশুটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাকে বাগে আনা এবার আর খুব কষ্টসাধ্য ছিল না। ছোরা হাতে হুজুর দাঁড়িয়ে থাকলেও তিনি মন্দিরে ঢুকতে অস্বীকৃতি জানালেন। নসুর ধমকেও কাজ হলো না।

অগত্যা ফয়জুল্লাহই গরুটাকে আবারো আল্লাহু আকবার ধ্বনি তোলে জবাই করে নিলো। একটা মহা বিপদ থেকে যেন নসু বেঁচে গেলো। সারাজীবন মাতব্বরির নামে মানুষের হাড়ের বদদোয়া নিয়েছে। সে নিজেও জানে তার পাপ আকাশ ছুঁয়েছে। সামান্য মাঝির ছেলে হয়ে এক পুরুষেই এতো সম্পদের পাহাড় গড়েছে সে। এতোখানি পথ আসতে তাকে অনেক অপরাধ সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে। এসব অপরাধ নিয়ে অবশ্য তার কোন অনুতাপ নেই।


আদতে অনুতাপ শব্দটির সাথে নসুরা একদমই অপরিচিত। জীবনের খরতাপে ওরা এতো বেশি উত্তপ্ত হয় যে চারপাশে দহন ছড়িয়ে দিতেই যেন তাদের জন্ম। সে আগুনে ছারখার হয় বিবেকবোধ,নীতি নৈতিকতা। অনুতাপগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। নসুরও কোন অনুতাপ নেই। নিজের অপরাধ নিয়ে অনুতপ্ত হওয়ার মতো এতোটা সুশীল সে নয়।আল্লাহ পাক তাকে ধনবানের ঘরে জন্ম দিলে সে কি এসব করতো ! নিশ্চয়ই না। তার অকাট্য যুক্তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এমন দু'চারটা অপরাধ কোন ব্যাপার না। ধনবান হওয়ার অধিকার তার ও তো আছে।

সে নিজ চোখেই মহাজনদের দৌরাত্ম দেখেছে। ধন আর প্রাচুর্যের অহংকারে তারা ছিল অন্ধ। নসুরা তাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকা কুকুরের মতো ছিল।


নসু হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এ পৃথিবীও অনেক বেশি স্বার্থপর। সেও কেবল যোগ্যতমকেই টিকিয়ে রাখে। আর যোগ্যতার পরিমাপ হয় অর্থ বিত্তের প্রতিযোগিতা দ্বারা। নসুও প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। জয় কোন সহজসাধ্য বিষয় নয়। সকল বিজয়ের পথই নিরিহ সাধারণ মানুষের রক্তে পিচ্ছিল থাকে। নসুর বিজয়ও ব্যতিক্রম নয়। বহু রক্তের আঠালো স্পর্শ এখনো তার দু'হাতে লেগে আছে।


রসু মাঝির সাত ছেলেমেয়ের মাঝে নসু চতুর্থ ছিল। অভাবের সংসারে জন্ম তার। বড় তিন তিনটে বোন।তিনবেলা ভাত জোটেনা, স্কুলে যাবার বালাই নেই, পরিধেয় বস্ত্র নেই, এতোসব নেই নেই এর ভেতরে নসুদের নিত্য বসবাস। বাপের সাথে ঘাটে যেতে হতো তাকে খুব ছোট বেলা থেকেই। বাপ ছেলে মিলে নৌকা বেয়ে যতখানি আয় করতো তা দিয়ে কোনভাবে সংসার চালাতো নসুর মা আয়মনা।

তাতে কোন এক বেলা ভাত জুটলে পরের বেলা আটার রুটি খেতে হতো তাদেরে। তাও প্রতিদিন ভাত বা আটা জুটবে তারও নিশ্চয়তা ছিল না। বড় বোন জরি একটু ডাগর হলে মহাজনের বাড়িতে চাকরানী খাটতে চলে যায়। আয়মনা নিজেই মেয়েকে ওখানে রেখে আসে। অন্তত পেট পুরে খেতে পাবে তো মেয়েটা। নিজের কাছে রেখে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতও তো দিতে পারে না তারা।


জরিও বেশ আনন্দ নিয়ে ও বাড়িতে যায়। যেন অভাবের সংসার থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মাঝে মাঝে আয়মনা গিয়ে মেয়েকে দেখে আসে। জরিকে দেখলেই মায়ের অশান্ত মন একটু শীতল হয়। অভাবের তাড়নায় পেটের সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখা আয়মনার জন্য কতখানি কষ্টের তা অন্য কেউ বুঝবে না।

তবে শান্তি এটুকুই যে ওবাড়িতে সুখেই আছে মেয়েটা। ভালো কাপড়চোপড় পরে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে,তেল সাবান পায়। আগের চেয়ে গায়েগতরে বেশ বেড়ে ওঠে জরি। পরিপাটি বেশভূষায় ভালোই লাগে। হাঁটাচলায় কৈশোরোত্তীর্ণ চপলতা মায়ের নজর এড়ায় না।বুকটা ধক করে উঠে। আবার নিজেই নিজেকে প্রবোধ দেয় এ বয়সী মেয়েরা একটুআধটু এমনি হয়। মা জরিকে বাড়ি আসার কথা বললে কাজের বাহানা দিয়ে আসতে চায় না।

সেই জরি মহাজন বাড়ি থেকে এক ঝড় বৃষ্টির রাতে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে আসে। ওরা ভাইবোন সবাই তখন গভীর ঘুমে। কারো করুণ কান্নার সুরে হঠাৎ নসুর ঘুম ভেঙে যায়।

ভেজানো দরোজা ঠেলে সে বাইরে আসে। জরি অঝোরে কাঁদছে আর মা তার দু'গালে ঠাস ঠাস শব্দে চড় থাপ্পড় মারছেন।

নসু কোন কিছু না বুঝেই বোনকে জড়িয়ে ধরে। বাক্রুদ্ধ আয়মনা তাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। সে ঘুমাতে পারে না। কান খাঁড়া করে শুনতে চায় কি ঘটনা। কিন্তু তার ছোট্ট মাথায় ঘটনার এতোটুকুও ঢুকেনি। বোনদেরে জাগিয়ে তোলে। ওরা হয়তো কিছু একটা আঁচ করে। দু বোন নসুকে বুকে জড়িয়ে রাখে।


পরদিন খুব ভোরে মায়ের আর্তচিৎকারে ঘুম ভাঙে সবার। গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে জরি সামনের বকুল গাছে ঝুলে আছে। নসু আজো জানেনা মহাজন বাড়িতে কি হয়েছিল,বুবু কেনোই বা মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছিল আর কেনো সে আত্মহত্যা করেছিল। তবে তার চোখ দু'টো আজো জ্বালা করে জরির কথা মনে পড়লে। জরির ঝুলে থাকা নিথর দেহটিকে দেখে ছোট্ট নসুর মনে হয়েছিল বুবু দোল খাচ্ছে। এখনো সেই দোল খাওয়া জরিবু'কে মাঝরাতে দোলতে দেখে নসু।

আর তখনি তার ভেতরের পশুগুলো মহাজনদের বিরুদ্ধে পাগলা কুত্তার মতো ক্ষেপে উঠে। দেয়ালে ঘুষি মেরে মেরে নিজের হাতকে রক্তাক্ত করে ভেতরের রক্তপিপাসু পশুগুলোকে দমন করে।

যদিও ভাগ্যের ফেরে মহাজন বাড়িটি একসময় তার হয়ে যায়, তবু রক্তের তৃষ্ণায় আজো সে ছটফট করে। এতো বড় বাড়ি নিজের করতে গিয়ে নসুকে অবশ্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। মহাজনদের কৌশলে পরাজিত করে জরির মৃত্যুর প্রতিশোধ খানিকটা নিয়েছিল সে।

নসুর চেয়ে প্রকৃতির প্রতিশোধ ছিল বেশি ভয়ঙ্কর। নির্বংশ হয়ে মৃত্যুবরন করেছে আলাউদ্দীন মহাজন। আর নসু তার স্ত্রীদের কাছ থেকে সুকৌশলে কিনে নেয় তাদের গোটা সম্পত্তি। সেটাও নসুর জন্য সহজ ছিল না। রক্তপাতের গোপন খেলা চলেছিল সেখানেও।


নসু নিজের জীবন থেকেই জেনেছে এ পৃথিবীর কোনকিছুই সহজলভ্য নয়, তাকে চড়ামূল্যে অর্জন করতে হয়। অনেক অনেক অপরাধ জড়ো করে সে মূল্যের ঋণ শোধতে হয় । মানুষের করুণ আর্তচিৎকার পকেটে পুরেই নসুরা অর্জনের পথ পরিষ্কার করে। জরির মৃত্যুর কিছুদিন পর মা মারা যান। মেয়ের মৃত্যু শোক কাটাতে পারেনি আয়মনা। দিনে দিনে বিছানা নেয় সে।


মায়ের মৃত্যু নসুকে ঘরছাড়া করে। তার কিশোর বুকটা ভাঙা কাঁচের টুকরো বিঁধে ফালা ফালা হয়। মা হীন ঘর মায়াহীন। অভাবের সংসারে আর কিছু না থাক খানিকটা মায়া থাকে। মায়ের মৃত্যুর সাথে সেটুকুও হারালো নসু। নিজেদের হারানোর আর কিছু নেই ভেবে একসকালে ঘাটে গিয়ে আর ফিরে আসেনি সে। পাশের নৌকার মাঝির সঞ্চিত টাকার পুঁটলিটা চুরি করে পালিয়ে যায়।

সে কোথায় গিয়েছিল কাক পক্ষীও জানতে পারেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে বাপ ভাইবোন। তাকে আর পায়নি।


দীর্ঘ দুই যুগ পরে যখন সে গ্রামে ফিরে এলো তখন আর নসু হয়ে ফেরেনি। ফিরেছিল নাসিম জোয়ার্দার হয়ে,টাকার খনি হাতে নিয়ে। চেহারায়, পোশাকে আশাকে বড়লোকি ভাব নিয়ে।

গ্রামের লোকজন তাকে চিনতে না পারলেও নসু তার পরিচয় গোপন করেনি। সগর্বেই পরিচয় দিয়েছিল রসু মাঝির পলাতক চোর ছেলে নসু সে। নিজের পরিচয়েই এলাকার দখল নিয়েছে সে। ক্রমে সে হয়ে ওঠে নসু মাতব্বর। প্রতি কোরবানির ঈদে এলাকার সবচেয়ে বড় দামী গরুটি তারই দখলে থাকে।

আজ ফয়জুল্লাহর জন্য কোরবানীটা হয়েছে নাহয় কোন উপায় ছিলনা। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে তার।ফয়জুল্লাহকে অনেক পুরষ্কার দেবে বলে মনস্থির করে। নসু ভাবে ফয়জুল্লাহর সাহস, সততা, আনুগত্য তাকে উপরে উঠতে সাহায্য করবেই। সে নিজেও এমন অনুগত ছিলো। সেও সাহসী ছিল,বসের প্রতি সৎ ছিল। অন্ধকার দুনিয়ায় নসুরাই হয়ে ওঠে বসদের পথ চলার আলোক মশাল। যদিও একসময় এইসব মশালের তীব্র আগুনে পুড়ে মরতে হয় বসদের। নসুও পুড়িয়ে মেরেছিল, আর সেই পোড়া দেহটাই হয়েছিল তার উপরে ওঠার সিঁড়ি।


ফয়জুল্লাহ অবশ্য তার মতো এতো বুদ্ধিমান নয়। এটা একটা ইতিবাচক দিক। তার উপর নির্ভর করা যায়। যে কোন মূল্যে ফয়জুল্লাহকে ডান হাত বানিয়ে রাখার চিন্তা করে নসু। এমন বিশ্বস্ত চাকর এই জামানায় মেলা ভার। তাকে তার প্রাপ্যের দশগুণ দিতে মনস্থ করে সে। যথারীতি কোরবানীর সকল কাজকর্ম সারতে সারতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। নসু ফয়জুল্লাহকে ডেকে বললো, " কাজ শেষ করে দেখা করিস। "


ফয়জুল্লাহ সেভাবেই নিচের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

তখন অনেক রাত। কাচারি ঘর নীরব নিস্তব্ধ। টেবিলের উপর রাখা ওয়াইনের বোতল,গ্লাস আর বরফকুচি। নসুর মাথার উপরে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে চার ডানাওয়ালা ফ্যান। এসিও চলছে। রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে হেলান দিয়ে বসেছে নসু। বরফ হিম ঘর। বাইরে যদিও প্রচন্ড উত্তাপ। পেছনে ফয়জুল্লাহ নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে।


"ফয়জুল্লাহ এসেছিস ?" জড়িয়ে জড়িয়ে জানতে চাইলো নসু।

কোন জবাব না পেয়ে তড়িৎ চেয়ার ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দু-চোখে রক্তজবা ফুটছে। মাথাও খানিকটা টলছে। আবেগের বশে হোক আর মাতাল হয়েই হোক নসু ফয়জুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। " বল কি চাস তুই ? আজ যে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিস তার জন্য তোকে যা চাইবি তাই দেবো। এত্তোগুলা পুরষ্কার দেবো। "

" কিছুই লাগবেনা মাতবর সাব। " নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিলো ফয়জুল্লাহ। নসুর মুখের ভক ভক গন্ধে বমি আসছিল তার।

" লাগবে না মানে ? আমাকে অপমান করছিস? জানস তো নসু এককথার মানুষ। "

ফয়জুল্লাহ তখনো নতমুখো নীরব। ফয়জুল্লাহর এই একটা আচরণ নসুর অপছন্দ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা। জোর করলেও চোখের দিকে তাকায় না। যেন তাকালে ঘৃণা উপছে পড়বে এমন ভাব।


কেনো যে এমন করে বুঝতে পারে না নসু।

" বল ভাই, আমি তোরে কিছু দিতে চাই। "

" মাতবর সাব আমাকে আমার চাওয়া মতো কিছু দেয়ার ক্ষেমতা নাই আপনার। " ঠাস করে বলে বসলো ফয়জুল্লাহ।

নসু অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।" বলেই দেখনা হাঁদারাম। আমার ক্ষেমতা কতখানি তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। একবার মুখ ফুইটে বল। নসুর কলিজা বাঘের মতো। "

ফয়জুল্লাহ তবুও চুপ করে থাকে।

দরদর করে ঘামতে থাকে সে। বুদ্ধি কম বলে অনেক ক্ষেত্রেই আগপাছ ভাবতে পারে না। হাতের মুঠি শক্ত করে যেন ভেতর থেকে সাহস সঞ্চয় করতে থাকে।

নসু জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। ফয়জুল্লাহ বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ দ্রুতবেগে নসুর পা জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে।


নসু তো বিস্ময়ে হতবাক।

" আরে আরে করছিস কি ? কি চাই তোর ? এভাবে কাঁদছিস কেনো ? "

"মাতবর সাব আল্লাহ'র দোহাই লাগে আমারে ফিরায়া দিয়েন না। "

"কি যা তা বলছিস ? তোকে আমিই তো দিতে চাচ্ছি। "

ফয়জুল্লাহ নসুর দু'খানা পা বুকে সেঁটে ধরে বললো, " আমার কৈতরিকে আমার কাছে ফিরায়া দেন মাতবর সাব। কৈতরির জন্যই আমি আপনার বাড়িত কামে আইছি। আপনে অনেক মাইয়া পাইবেন। কৈতরিরে তালাক দেন আপনে। আমি কৈতরিরে নিয়া গ্রাম ছাইড়া চইলা যামু।"

ফয়জুল্লাহর কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে নসু। এও কি সম্ভব ? সে কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে ? ফয়জুল্লাহ কি বলছে এসব ? এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার।

আরেকবার শুনে নিশ্চিত হতে চায় সে যা শুনলো তা সঠিক কি না।

" কি বললি আবার বলতো ? "

" আমার কৈতরিকে ফেরত চাই মাতবর সাব। ওরে আমি অনেক ভালবাসি।"

নসুর দু’চোখে দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠলো। মাত্র দু’মাস হয় কৈতরিকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে সে বিয়ে করে এনেছে।

বলে কি এই গণ্ডমূর্খটা।


তার বউকে চায় ঘরের চাকর। এতো বড় দুঃসাহস ! রাগে অগ্নিশর্মা নসুর সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে।

একটা লাথি দিয়ে ফয়জুল্লাহকে ঘরের কোণে ফেলে দেয়। তারপর আরো কয়েকটা লাথি।

একটা জীবন্ত মানুষ ফুটবলের মতো কাচারি ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে গড়াচ্ছিল নসুর পায়ে হয়ে।

তারপর ক্লান্ত হয়ে কাকে যেন ফোন দিয়ে আসতে বলে নসু।

মুখে খিস্তি ঝাড়তে ঝাড়তে হনহন করে বেরিয়ে আসে

কাচারি ঘর থেকে। দরোজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে ভেতর বাড়িতে চলে আসে সে। ফয়জুল্লাহ ওখানেই পড়ে থাকে।

ওখানেই গোঙাতে থাকে। পুরো শরীর কেটে রক্ত ঝরছে অবিরাম।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে বড় বউকে পাশ কাটিয়ে ছোট বউর ঘরে ঢুকে নসু। কৈতরি একহাত ঘোমটা টেনে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়।


কৈতরির দিকে মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে সে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একগাছি পায়েল বের করে আনে। কৈতরির পা খানা কোলে উঠিয়ে আলতো হাতে পায়েল পরিয়ে দেয়।

" বউ তোরে খুব ভালবাসি। তোরে রাণী বানায়া রাখবো। আমার সাথে বেঈমানী করিস না শুধু। "

কৈতরি খোলা জানালার বাইরে জোছনাফোটা আকাশের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে। দশমীর চাঁদ তখন ঝলমল করছিল গোটা আকাশ জুড়ে। ফুলের রেণুর মতো ঝরে পড়া জোছনায় নিজের জমানো ভালবাসা বিসর্জন দিতে গিয়ে নিজেকে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করে সে।

ভালবাসা থেকে ছিটকে পড়া ক্ষরিত রক্তের স্রোতে ভেসে চলে কৈতরি। কোথায় তার গন্তব্য সে নিজেও জানে না।


সে বিস্মিত হয় তার সামনে নসু নয় যেন ফয়জুল্লাহ দাঁড়িয়ে। এক অবাক করা গায়ের গন্ধ এসে নাকে লাগে। কৈতরি ছটফট করে উঠে। ক্ষরণের নদীজলে বেহুলার নাও ভাসায় সে। সাপেকাটা মৃত নসু নাকি ফয়জুল্লাহ শুয়ে আছে নায়ের ভেতরে সাজানো বিছানায়, বিভ্রান্ত হয় সে। নসুর আকুতি স্পর্শ করে তাকে। হাজার হোক স্বামী বলে কথা। কিন্তু বুকের ভেতরে এতো ভাঙন কেনো বুঝতে পারে না। দলা দলা শূন্যতা গ্রাস করে। জোছনায় ভাসছে রাতের এ গ্রাম অথচ কবরের অন্ধকার যেন তার সমস্ত ঘর জুড়ে।


নসুর লোমশ বাহুর আলিঙ্গনে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে এক কঙ্কালের লাশ।

পরদিন সকাল থেকেই ফয়জুল্লাহ নিখোঁজ। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নসু চারদিকে লোক পাঠালো। যে করেই হোক ফয়জুল্লাহকে খুঁজে আনা চাই। নসুর আহাজারি আর বুক চাপড়ানো দেখে গ্রামবাসীর চোখও ছলছল করে উঠলো। সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। কোথাও লোকটা নেই। এক রাতের মধ্যেই কোন এক অদৃশ্য শক্তিবলে একটা জলজ্যান্ত মানুষ গায়েব হয়ে গেলো যেন।

গতকালের ঘটনা নিয়ে কেউ কেউ গুঞ্জন তুললো। নির্ঘাত ওই মন্দিরের অভিশাপ। মানুষের চোখে মুখে ভয় আর উৎকণ্ঠা।

গুঞ্জন মিথ্যে হলো না।

কেউ একজন মন্দিরের বাইরে ফয়জুল্লাহর একপাটি স্যান্ডেল দেখতে পেয়ে ছুটে এসে খবর দিলো।

নসু পুলিশকে তৎক্ষনাৎ জানালে পুলিশ এসে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে ফয়জুল্লাহর লাশ সনাক্ত করলো। তার সারা শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিকৃত।

মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে গেলো পুলিশ।

স্তব্ধ গ্রামবাসীরা আবারো মন্দিরের ভয়ে জড়োসড়ো। আবারো মহা আতঙ্কে বলাবলি শুরু করলো, " গতকাল ফয়জুল্লাহ যদি মন্দিরে ঢুকে গরুটাকে জবাই না দিতো তাহলে তার এই দশা হতো না। "

প্রচন্ড ভয়ে অনেকেই এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

আর এদিকে নসু থানায় বসে অপঘাতকের হাতে নিহত তার খাস চাকরের জন্য বুক চাপড়িয়ে অশ্রুপাত করে চললো।


25 views0 comments
bottom of page