top of page

স্বাধীনতা দিবসের গল্পঃ মাশরুরা লাকী



এন্টিক শিলালিপি


দুধসাদা আলোকচুলায় মাটির হাঁড়িতে কালাচাঁন বেপারী দুপুরের পর থেকে ভাত বসিয়ে রেখেছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হতে চললো। এদিকে প্রচণ্ড ক্ষুধায় বমি বমি ভাব উপক্রান্ত হচ্ছে। নাড়ি-ভুঁড়ি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবুও ভাত রান্না যেন আর শেষ হয় না। সত্তর ঊর্ধ্ব কালাচাঁন বেপারী নিজেকে কষে একটা ধমক দিয়ে বললো- নফস তুই শান্ত হয়ে যা।


বিশাল চর। নীরব সুনসান। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর বুকচোষা চরে পলি মাটিতে জোছনার আলোয় যেন এন্টিক শিলালিপির সৌন্দর্য ঝলকানি দিচ্ছে। চরে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে একচালার একটা চাপড়াঘর আর বারো বছরের এক বিস্ময় বালক তার একমাত্র সঙ্গী। তবে বিগত তিনদিন যাবত এই বিশাল চরে কখনো সে একাকী শামুকছানা কখনো বা ডাঙায় পাহারারত স্ফিংক্স মুক্তিকামী প্রেমিক আটপৌরে যুবক।


এদিকে শিউলি ও শেফালী দু'বোন। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। অকস্মাৎ হল ত্যাগ করার নির্দেশ এলে তড়িঘড়ি করে দু'বোন একা একা গ্রামের বাড়িতে রওনা দেয়। তাদের গায়ে জড়িয়ে নেয় কালো রঙের বোরকা। বোরকা কিছুটা ছোট হওয়ায় মুখ ঢাকলে পা বেরিয়ে আসে। আবার পা ঢাকতে গেলে মুখ বেরিয়ে যায়। অতঃপর তারা সিদ্ধান্ত নিলো মুখ ঢেকে রাখবে।


ছাগলা দাড়ি, চিকনা পাতলা শরীর, মাথায় জিন্নাহ টুপি। গুদারা ঘাটে পায়চারি করছে ফালু মিয়া ওরফে ফাইল্যা। শিউলি ও শেফালী ঘাটে নামতেই ওদের দুধপুলির মতো পা দেখেই ফালু মিয়া দু'বোনের হাত চেপে ধরে। প্রশ্ন করে, তোমরা কারা? মুখ খোল....

তারপর হিন্দু দালানবাড়ির একটি কক্ষে বন্দি অবস্থায় চোখ মেলে দেখলো-ফালু মিয়া। ফালু মিয়া যেন কথার ফুলঝুরি। সঙ্গে সঙ্গেই বলতে থাকলো "হৃদয় বলে কোনো বস্তু নেই, যে তোমাগো আবেগের আক্রোশে আমার হৃদয়ে ঝড় উঠবো। মানুষ তো আসলে সুযোগের অভাবে সৎ হইয়া থাকে। আদিম লোভাতুর চোখে পিশাচের চিৎকারে বললো-শোন মাইয়ারা, আমি সিদ্ধান্ত নিছি এই যুদ্ধের ডামাডোলে গ্যারামের বেবাক যুবতী মাইয়াগো আমি বিবাহ করুম। টাটকা মাল আমার কাছে যেন বেহেশতী জারবেরা। তারপর মিলিটারীগো হাতে তুইলা দিমু। দু'হাত ভইরা টাকা কামামু। আর তুমাগোও কোনো কষ্ট হইবো না। মিলিটারীগো খুশি করতে পারবা। ঠাডা পরার মতো দু'বোনের কানে কথাগুলো ক্রমশ বেজে চলেছে। দু'বোনের চোখ অচঞ্চল নীরব শান্ত চোখে তাদের স্বপ্নলোকের চাবি হাতে চির বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়।


স্বাধীনতা সংগ্রামের সে দিনগুলিতে ভয় আর শঙ্কার মধ্যে প্রতিনিয়ত দিন কেটেছে। মুক্তি বাহিনীর একজন ছেলে আশ্রয় দিতে পারলে কালাচাঁন বেপারী নিজেকে ধন্য মনে করে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কান পেতে সজাগ থাকতো- কোথাও কোনো গুলির শব্দ হয় কিনা। এই মুক্তিবাহিনী তরুণ ছেলেগুলোর দিকে যেন তাকিয়ে আছে পুরো দেশ তথা বাঙালি জাতি।


সাঁঝের বেলায় বিশাল চরে কালাচাঁন বেপারী চেলাকাঠে পিঠ ঠেকিয়ে যেন কামেল ফকির ধ্যানমগ্ন। হঠাৎ বার বছরের বিস্ময় বালক ছেলেটা এসে হাজির। সঙ্গে একদল তরুণ ও যুবক ছেলেরা জড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। তাদের কারো গায়ে গেঞ্জি, পরনে ফুলপ্যান্ট। কারো কারো গায়ে হাওয়াই শার্ট ও পরনে লুঙ্গি। কারো পিঠে ঝুলে আছে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। কারো কারো হাতে স্টেনগান। আর দু'একজনের হাতে এল.এমজি। চোখের পলকে সবাই ছড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল চরে শব্দ আর প্রতিশব্দে যেন উপরের আকাশের বুক থেকে দ্রুত বেগে ছুটে আসছে প্রকাণ্ড এক দজ্জালের প্রতিধ্বনি। তারপর একসময় চারিদিক নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ......

বিশাল বুকের ছাতি ক্রমশ ছোটো হতে হতে কোথায় যেন মিলিয়ে যেতে লাগলো। কোনো অভিযোগ নেই। একটা মায়াপাখি যেন অনবরত জোরে জোরে লাথি মেরে চলেছে। আর সারিবদ্ধ পিঁপড়ের দল সমস্ত শরীর জুড়ে কামড় বসিয়ে দিচ্ছে। কালাচাঁন বেপারী অস্ফুটে হেসে বললো - আহ! মুক্তি।

9 views0 comments
bottom of page