top of page

স্বাধীনতা দিবসের গল্পঃ সেলিনা আখতার



মানচিত্র

(মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প)


বানিশান্তা পতিতালয়ের সামনে জীর্ণ নোংরা কাপড়ে বসে আছে এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক। কেউ হেঁটে যাচ্ছে বুঝতে পারলেই তার সামনে হাত পাতছে - বাবা আমারে খাওনের জন্য কয়ডা টাহা দিবা। ও বাবা আমার মেলা অসুখ তোমরা আমারে কিছু টাহা দাও একটু ওষুধ খাব।


কত মানুষ হেটে যাচ্ছ কিন্তু তাকিয়েও দেখছেনা। মাঝেমধ্যে দু একজন দু পাঁচ টাকা মহিলার থালায় ফেলে দিচ্ছে। পাশেই পতিতালয়ের সারিবদ্ধ ঘর । সেখান থেকে হাই ভলিউমের হিন্দি সিনেমার গান ভেসে আসছে, সাথে উদ্দাম বাজনা । এখন বিকেল। ডিসেম্বর মাসের বিকেল মানেই সন্ধ্যা হয় হয়। দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি সে। তারমানে সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। পেটের ক্ষুধা যেন তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর করে উঠে দাড়ায় বৃদ্ধা। গলির মুখের দোকানের সামনে দাড়িয়ে বৃদ্ধা বলে আমারে একটা রুটি দে। দোকানদার ছেলেটা বলে-হ দেবতো, টাহা আনছ?

-ওই গুলামের বাচ্চা গুলাম, আমি কি তোর কাছে মাগনা চাইছি?এই নে তোর টাহা। বলেই পাঁচ টাকার একটা নোট ছুড়ে দেয় ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ছুড়ে দেয়া টাকাটা ধরে ফেলে। একটা বন রুটি বৃদ্ধার দিকে এগিয়ে দেয়। এবার বলে-ও ময়না নানি খাবানে কি দিয়ে? বলেই কলার ফানা থেকে একটা আধপঁচা কলা হাতে দেয়।–ইডার টাহা দিয়া লাগবেনানে। ময়না নানি কলাটা হাতে নিয়ে কিছুটা খুশি মনে চলে যায়। আধা পচা কলাটা হাতে পেয়ে তার মুখটা কেমন যেন খুশির আলোয় ভরে গেল।


এই বৃদ্ধাকে ময়না নামে সবাই চেনে। সবাই ময়নাবুড়ি বলে ডাকে। সন্ধ্যা হয়নি এখনো। ময়নাবুড়ি কাঁপাকাঁপা পায়ে এগুচ্ছে সামনের দিকে। গন্তব্য লঞ্চ ষ্টেশন।ওখানে বসলে রাতে ভাত খাওয়ার টাকা পাওয়া যায়। এখানে সে দিনে আসেনা। পরিচিত কেউ দেখলে কথনো কখনো বেশ্যা বলে গালি দেয়। সেও মুখ খিস্তি করে কিন্ত ভালো লাগেনা আর। এভাবে আর কত দিন বেঁচে থাকা। মরতে ইচ্ছে করেছে বহুবার কিন্ত মরা হয়নি। ময়না মরতে পারেনি, কিন্ত কতটুকু বেঁচে আছে? এর নাম কি বেঁচে থাকা ? সেই দিন যদি মরতো তবে কি হতো? মরলেই হয়তো বেঁচে যেত। মনে পড়ে আগুন আগুন সেই দিন।


১৯৭১ সাল। নতুন বউ ময়না। ডাগর শরীরের গঠন, দুধে আলতা গায়ের রং। সাধারণত গরীবের ঘরে এমন চেহারার মেয়ে হয়না। রমিজ মিয়ার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। জমি নাই বরগা চাষ করে, ছনের ঘর আর ছোট আকারের একটা পুকুর, গরু বাছুর বলতে হালের দুটো বলদ রমিজ মিয়ার। রমিজ আর ময়নার বিয়েতে ময়নার বাপ কিছুই দিতে পারেনি। তারপরও মেয়ের সাথে তার দুধেল গাভী আর তার বাছুরটা দিয়েছে।মেয়ে তার দুধ খেতে ভালোবাসে। গরীবের সংসার, এই গাভীর দুধ আধ সের নিজেরা খায় বাকিটা যোগান দেয়া। তারপরও নিজেদের কথা না ভেবে মেয়েকেই গাভী আর তার বাছুর উপহার হিসেবে দিয়ে দেয়। পাঁচ মাস আগে ময়নার বিয়ে হয়েছে। গাভী লালন পালন করা থেকে সব কাজ নিজে হাতে করে ময়না।


রমিজের বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছয় বোনের ছোট রমিজ মিয়া। সবাই যার যার সংসারে আছে। ময়নার শাশুড়ি নসু বিবি বেঁচে আছে। বৃদ্ধা অন্ধ, দুবছর আগে গুটি বসন্তে তার দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। বড় ভালো মেয়ে ময়না। শাশুড়ির যত্ন নেয়া সংসারের সব কাজ এক হাতে করে সে। সত্যি সত্যি সুখী হয়েছে ময়না। বাপের দেয়া বাছুর গরুটার গা মুছে দিতে দিতে মনে মনে বলে বড় বাছুরটা এখন বেশ বড় হয়েছে । ও যখন বাচ্চা দিবে তখন আর বাপের কষ্ট থাকবেনা। ওরে বাপের কাছে দিয়ে দেবো।


ময়নাকে পেয়ে রমিজের খুশি ধরেনা। রাতে বিছানায় ময়নার মুখে হাত বুলিয়ে ওর মাথাটা বুকে জড়িয়ে বলে বড় ভালা বৌ পাইছি আমি। ময়নারে তুই আমারে বড়ই খুশি করছস। দেখবি আল্লায় তরেও অনেক ভালা রাখবো।ময়না হাসে -এই গুলা আপনে কি কন, এইডা আমার সংসার। আমার সংসার আমি ভালো না বাইসা পারি কন। আবেগে আরো জড়িয়ে ধরে রমিজ ময়নাকে।

–বৌ আমাগোর একটা মাইয়া হইবোনা? আল্লারে কই মাইয়াডা যেন অবিকল তোর মত হয়।

ময়না কিছুটা ঝামটা দিয়ে বলে –না না আমাগো একটা পোলা হইব। পোলা হইলে আপনের কাজে সাহায্য করতি পারবে। এমন হাজার কথায় কথায় রাতের আঁধার খুশির জোয়ারে ভেসে যায়। যেন গরীবের ঘরে রাজরানী সে। ময়না এতো ভালো স্বামী সংসার পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানায় আল্লার দরবারে। রমিজ ময়নাকে আরো একটু জোরে জড়িয়ে ধরে । বৌরে তুই একটু সাবধানে থাহিস। চাইর পাশের যে অবস্থা তাতে কখন কি হয় কে কইতে পারে। আমার মেলাই ডর লাগে। রমিজ অনেকটা চিন্তিত।

ময়না রমিজের বিয়ের দুইমাস পরেই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের ভয় ময়নারও কম লাগেনা। কম বেশি সেও শুনেছে মিলিটারির অত্যাচারের কথা। আবার তাদের গ্রামের কেউ কেউ মিলিটারির সাথে হাত মিলিয়ে সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করছে এ কথাও সেও শুনেছে। আর এজন্য তার মনের ভেতর কু গাইতে থাকে সবসময়।


গরমের দিন, আকাশ যেন উপচে তাপ দিচ্ছে। নসু বিবি চোখে দেখেনা। বারান্দায় একটা খেজুর পাতার পাটির পরে বসে আছে। হাতের লাঠিটা বাম হাতে ধরে অকারণে ঠক ঠক করছে। একা একা অকারণে কথা বলছে।

-ওই বৌ, বৌ তরে না কইলাম আমারে এক বাটি দুধ দে। ওই ময়না তরেনা কইলাম আমারে এক বাটি দুধ দে। তর কুমড়ার তরকারী আমার খাইতে মন চায়না।

শাশুড়ির কাছে এসে ভাতের থালাটা কাছে এগিয়ে দিয়ে বলে

- আম্মা আপনেরে কতবার কইলাম আইজ রশি ছিঁড়া বাছুর দুধ খাইছে। অল্প দুধ হইছে খান সাহেবের বাড়ি লইয়া গেছে আপনের পোলা। তাগো বাড়ি শহর থেইকা মেলা মানুষ আইছে। আম্মা আপনেরে সন্ধ্যাকালে দুধ দুয়ে দিবানি।

-কি দিন পড়ছে। শহর খালি কইরা সব মানুষ বুঝি গেরামে আসতেছে। কি হইছে ও বৌ তুই কিছু জানোস? ততক্ষণে ময়না যে সেখানে নেই তা আর সে দেখতে পায়ন।


(২)


-ওই আদুরী খাড়া, খাড়া, সকালে একবার দুধ খাইছস, আম্মারে দুধ দিবার পারি নাই, তুই খাড়া। ময়নার এ কথায় কোন প্রকার কর্ণপাত করেনা আদুরী। ছুটছে আদুরী। কে কার কথা শোনে। গরুর বাছুর আদুরীর পিছু পিছু ছুটছে ময়না। গরমের দিন আদুড় গায়ে লালপাড় সবুজ রংয়ের মোটা কমদামী শাড়ী পেঁচিয়ে রেখেছে ময়না। দুটো মাত্র ব্লাউজ, একটা তুলে রেখেছে বেড়াতে যাওয়ার সময়ে পরবে বলে। অন্যটা আজ খারে ভিজিয়ে কেঁচে দিয়েছে। বাড়ির বাইরে তার আসার কথা নয় তারপরও আদুরীকে ধরার জন্য না ছুটে পারেনি। বুড়ো অন্ধ শাশুড়ির পাতে আজ রাতে একটু দুধ দিতে হবে তার।


আদুরী ময়নার কথা শোনেনি তবে একজন ঠিকই শুনেছে। আদুরীকে ধরতে যেয়ে সামনে যে মানুষ আছে সেটা খেয়াল করতে পারেনি। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয়। খসে পড়া আঁচল ঘুরিয়ে মাথায় ঘোমটা টানে। একটুখানি মাথা উঁচু করে তাকায় কলিমুদ্দিন শেখের দিকে। মানুষটার চোখের দৃষ্টি আর হাসি ভীষণ কুৎসিত মনে হলো। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো ময়নার।তাড়াতাড়ি মাথা নিচু করে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় ময়না। কলিমুদ্দিনের পাশ কাটিয়ে যেতে যায় কিন্তু পিছন থেকে শাড়ীর আঁচলে টান লাগে, ঘোমটা খসে যায়। তড়িৎ বেগে ঘুরে দাড়ায়। কলিমুদ্দিনের হাতের মুঠোয় ওর শাড়ীর আঁচল ধরা।

বুকের ভেতর ধড়ফড়ানি কিছুতেই কমছেনা । মনে হচ্ছে কত বছর যেন দৌড়ে পার করেছে ময়না। কিভাবে কলিমুদ্দিনের কবল থেকে পাট খেতের ভেতর দিয়ে কতোটা দৌড়ে এসেছে বুঝতে পারছেনা। উঠোনের এক কোনায় পাটখড়ির বেড়ায় হেলান দিয়ে মাথা ঠেকায়। উনিশ বছরের ময়না মাত্র দুমাস হলো নিজের ভেতরে নতুন প্রাণের অস্তিত্ব একটু একটু টের পায়। এখনো নতুন বৌ সে, স্বামীকেও বলা হয়নি একথা । হাঁপাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বেড়ায় গোজা গামছাটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। পুরনো শাড়ীর আচলের একাংশ কলিমুদ্দিনের হাতে রয়ে গেছে। ধরাপড়া শালিকের বাচ্চার মতোই ওর অবস্থা। বাইরে শুকনো পাতায় পায়ের খসখস আওয়াজে ময়না ভয় পেয়ে ঘরে ঢুকে খিল দেয়।


রমিজ উঠোনে দাড়িয়ে দেখে কেউ নেই। ময়না ময়না জোরে জোরে ডাকে। দুপুর বেলা দরজা বন্ধ দেখে কিছুটা অবাক হয়। নসু বিবি বলে ওঠে -কখন থেইকা ডাকতাছি, শোনেনা। ময়না রমিজের গলা ভালো করে শুনে দরজা খুলে সামনে এসে দাড়ায়। বিধ্বস্ত ময়নার চেহারা দেখে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রমিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে টেনে ঘরে নিয়ে আসে ময়না। দরজায় খিল তুলে দেয়। হতবিহবল রমিজ ভয় পেয়ে যায়। দুহাতে মুখ চেপে ময়না বলছে- কেউ নাইতো?রমিজের কথায় আসস্ত হয়ে ময়না কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া কথাগুলো সবিস্তারে বলে । চিন্তিত রমিজ ময়নাকে তার বাপের বাড়িতে রেখে আসার কথা বলে।কিন্ত ময়না রাজি হয়না। রমিজের ডান হাতটা নিজের পেটের সাথে চেপে ধরে বলে কাউরে পাও? কারো ধুকধুকানি শুনতি পাও। চমকিত রমিজের চোখে ভীষণ খুশির ঝিলিক খেলে থেমে যায়। দুই হাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কাঁদছে ময়না। দুজনেই বুঝতে পারে তারা বিপদে পড়তে পারে। ময়নার মাথাটা বুকে জড়িয়ে রমিজ বলে, কান্দিসনা, যেমনি কইরে হোক আমাগের সন্তানরে বাইচটি হবে। দরকার হইলে আমরা ইন্ডিয়া চইলে যাব। তুই বাড়ির বাইরে যাইসনে বৌ। আমি বাইরের কাজ করব। মারে আর নিজেরে দেইখে রাখিস।


কিন্ত হলোনা ওদের ভারতে যাওয়া। অন্ধ বৃদ্ধা মা নসু বিবিকে সাথে নেয়া যায়না আবার একা রেখে যেতে পারেনা। একদিন খুব ভোরে অনেক মানুষের চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গে। ভয়ে গরমে রাতে ঘুমাতে পারেনা। ভোরের দিকে সবে মাত্র চোখ লেগে এসেছে। ধড়ফড় করে উঠে বসে। লাফ দিয়ে উঠে দাড়ায়। বারান্দায় ঘুমোয় নসু বিবি। ওখানে দাড়িয়ে সেও চিৎকার করছে।রমিজ দরজা খুলে বাইরে এসে দাড়ায়। এক হাতে মায়ের হাত আর এক হাতে বৌয়ের হাত ধরে হতভম্ব রমিজ কোন দিকে যাবে দিশা পায়না। পুকুরের দিকে পা বাড়ানেরা সাথে সাথে জম দূতের মতো চার পাঁচজন পাক সেনা দেখতে পায়। আচমকা এই অবস্থায় কি করবে বুঝে ওটার আগেই একজন সেনা ময়নার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের ভেতরে ঢুকে য়ায়। পরপুরুষের এই ছোঁয়ার ঘৃণা ভয় সব একসাথে জড় হয়েছে। ছাইড়া দাও, আমারে ছাইড়া দাও আমার প্যাডে সন্তান আছে। রমিজ এগিয়ে যায় ময়নার দিকে। দুম করে একটা বুলেট এসে লাগে রমিজের বা কাঁধে। কয়েক হাত ছিটকে উঠোনে পশ্চিম দিকের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রমিজের দেহ। কলকল করে রক্ত ঝরছে। ঘরের ভেতর সৈন্যদের উল্লাস আর ময়নার গোঙ্গানির শব্দ। সেনাদের পৈচাশিকতা তখন মাত্রা ছেড়েছে। একে একে চারজন পাকি সেনার অত্যাচারে ময়না বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝা যাচ্ছেনা। তবে সেনারা কলিমুদ্দিনের ঘাড়ে হাত দিয়ে আচ্ছা আদমি আর সাচ্চা মুসলমানের খেতাব দিয়ে যায়। সেই সাথে ময়নাকে তাদের গাড়িতে তুলে দেয়ার ইশারা করে।


কলিমুদ্দিন সঙ্গীদের নিয়ে ঘরের ভেতরে আসে । মাটিতে পড়ে আছে ময়না। মাটির মেঝে শুষে নিচ্ছে তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা তাজা রক্ত। কলিমুদ্দিন ময়নার নাকের কাছে হাত দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দেখে খুশি হলো। মুচকি হেসে ময়নার দেহের দিকে তাকিয়ে বলে আমারে মানলিতো আমি একাই থাকতাম, যা এখন সক্কলের মন জুগায় বেড়া। আধমরা প্রায় বিবস্ত্র ময়নাকে কলিমুদ্দির লোকেরা পাক সেনাদের গাড়িতে তুলে দেয়। যাবার সময়ে রমিজের খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। আর নসু বিবি সমানে একবার ময়না আর একবার রমিজ বলে ডাকছে।কলিমুদ্দির এক চরের হাত জড়িয়ে ধরে বলে আমার রমিজ নাকি? ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নেয় পাষণ্ড। সামলে উঠতে না পেরে আগুনের পাশে যেয়ে পড়ে। আর তাকে ছেলে আর ছেলে বৌ এর জন্য দুঃখ করতে হলোনা, পুড়ে মরলো নসু বিবি।


তারপর কতদিন কতরাত গেছে বা কতজন পাকির অত্যাচার ময়না তার দেহ সহ্য করেছে জানেনা। হিসেব রাখতে পারেনি। তবে জানে রমিজের ঘরেই রমিজের সন্তান নষ্ট হয়েছিল পাকিদের অত্যাচারে। সেদিন ময়নার শরীর খেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের সাথে তার পিতার ভিটায় রেখে এসেছিল বড় সাধের সন্তানের চিহ্ন। দেশ স্বাধীন হলে ময়নাকে ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে একটা সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করে। বেশ কয়েকদিন পরে ছেড়ে দেয়। কিন্ত কোথায় যাবে সে? শরীরে রমিজের সন্তানকে ধারণ করে রাখতে পারেনি কিন্ত পাকি শকুনের রেখে যাওয়া চিহ্ন এখন স্পষ্ট। নষ্ট করার সময় পার হয়ে গেছে।অনেক পথ ঘুরে ময়নার আশ্রয় হয় বানিশান্তা পতিতালয়ে। তার পেটের মেয়ে সন্তান সেখানেই জন্ম নেয়। চোখ ধাধানো রুপের জন্যই সেদিন আর্মিরা তাকে রেখে যায়নি। অসুস্থ হলেও সেই রূপের জন্যই বানিশান্তায় তার আশ্রয় হয়। সে অনেক অলিখিত কষ্ট আর অশ্রুগাঁথা।


আর রমিজ?

আরো অনেক লাশের সাথে রমিজের দেহটা রাখা হয়। অনেক বড় গণহত্যা ঘটেছিল সেদিন সেই অজগ্রামে। কত রক্তে মাটি ভিজেছিল আজ মনে নেই। শুধু সব ঘরে সেদিন কান্নার শব্দ ছিল। সেদিনের কান্না এখনও কেউ কেউ কাঁদছে নিভৃতে। রমিজের লুঙ্গি গেঞ্জি রক্তে ভিজে একাকার, দেহ নিথর। এতো লাশ আলাদা আলাদা কবর দেয়া সম্ভব না। তাই যারা বেঁচে ছিলো তারা গণ কবরের সিদ্ধান্ত নিল। একটা লম্বা কবর খোঁড়া হয়েছে।ঊনত্রিশটা লাশ একে একে নামানো হচ্ছে।

রমিজের লাশ কবরে নামানোর সময়ে একটু নড়ে ওঠে। একটুখানি গোঙ্গানির শব্দও শোনা যায়।যারা নামাচ্ছিল তারা আস্তে চাপা গলায় বলে রমিজ মরে নাই। রমিজ মরে নাই, বাঁইচা আছে। তারপর সেদিন সত্যি সত্যি রমিজ বেঁচে যায়।


কাঁধের অনেকটা মাংস গুলির আঘাতে উড়ে যায়। প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল। বলা যায় অলৌকিক ভাবেই রমিজ সেদিন বেঁচে যায়। চিকিৎসার পরে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু গ্রামে আর থাকেনা। মা নাই, বৌ ময়না নাই, সংসার নাই। হায়েনারা সেদিন চলে যাওয়ার পরে ওর হালের বলদ দুটো কলিমুদ্দিন ধরে নিয়ে যায়। আর ময়নার বাপের দেয়া দুধের গরুটার কি হয়েছে তা কেউ জানেনা।


পোড়া ঘর আর উঠোনের দিকে চেয়ে বুক ফেটে যায়। ময়নার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সুখে ভরে উঠেছিল দরিদ্র রমিজের সংসার। আর শেষ সময়ে ময়না যে অদেখা সন্তানের কথা বলেছিল সেও যেন পাশে দাড়িয়ে বলছে –বাপজান বাঁচাও। আর সহ্য হয়না তার। কিছুতেই সে শূন্য ভিটায় একা থাকবেনা। বাঁচতে চায়না রমিজ, তবে যারা তার ভরপুর সংসার বিরাণ ভূমি করলো তাদের একজনকে হলেও সে মারতে চায়।


একটু হাটতে, চলতে শিখেই অসীম শূন্যতা নিয়ে রমিজ একদল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভারতে চলে যায়। জীবন কি থেমে থাকে? কারো সুখ দুঃখ কোন কিছুর জন্য সময় থেমে থাকেনা। সময়ের সোতে জীবন এগিয়ে যায়। এক সময়ের গোবেচারা বর্গা চাষি রমিজ দেশ স্বাধীনের পরে এস এল আর হাতে দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রমিজ হয়ে গ্রামে ফিরে এলো। এর মাঝে সে একবার কলিমুদ্দিনের বাড়িতেও চড়াও হয়েছিল। কালিমুদ্দিন পলাতক, বাড়িতে ছিলোনা। শিশু আর মেয়েদের গায়ে হাত দেয়নি রমিজ। তার বোঝাপড়া কলিমুদ্দিনের সাথে। কিন্তু বোঝাপড়া হয়না আর কোনদিন। সময় আস্তে আস্তে কলিমুদ্দিনদের পক্ষে চলে যায়।


রমিজকে সকলে বিয়ে করতে বলে। সবাই বলল, ময়না ফিরে এলেও তাকে নিয়ে আর ঘর করা সম্ভাবনা কারণ মিলিটারি আর রাজাকারেরা ময়নাকে নষ্ট করে ফেলেছে। শুনে ক্ষেপে যায় রমিজ- আমার বৌ আমি সংসার করব তাতে কার কি? তবুও এক সময় রমিজ রাজি হয় বোনদের কথায়। কারণ সে নিজেও কোনভাবেই একা থাকতে পারছিলনা। আর দুইমাস হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে, ময়না ফিরে আসেনি। আর হয়তো ফিরে আসবেনা। কিন্ত কোন মেয়ের কথা বললেই ময়নার কথা মনে পড়ে। ময়নার মুখখানা যে ওর বুকের খাঁচায় বন্দী হয়ে আছে। বোনেরা অনেক বুঝিয়ে অবশেষে রমিজকে পাশের বাড়ির জুলেখার সাথে বিয়ে দেয়।

সময় গড়ায়, রমিজের চার ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ছেলেরা তিনজন ক্ষেত খামার করে। ছোট ছেলে এস এস সি পাশ করেছে। এখন ঢাকা শহরে থাকে। এই ছেলেটা পড়তে চায় কিন্তু তার পড়ার খরচ কে দেবে। তাই নিজে কাজ করে কেমন করে যেন লেখাপড়া করে ছেলেটা। সে নিজে লেখা পড়া জানেনা। তারপরও ছেলেকে বাধা দেয়নি। মাঝে মাঝে বুক চিরে শ্বাস বেরিয়ে আসে। কেন তার এই দীর্ঘশ্বাস?


কলিমুদ্দিনের অবস্থা আগের চেয়ে আরো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আবার সব ক্ষমতা কলিমুদ্দিনদের হাতে চলে গেছে। জমি টাকা কোনটার অভাব নাই। দুইবার চেয়ারম্যান ছিলো। এখন কলিমুদ্দিন এলাকার এম পি। কলিমুদ্দিনের পরিবার ঢাকা শহরে থাকে। বয়সে কলিমুদ্দিন আর রমিজ একই সমান।রমিজের চেহারা ভাঙ্গাচোরা, বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কলিমুদিন অনেক শক্তপোক্ত। প্রতি বকরা ঈদে আসে, গরু জবাই করে গ্রামের মানুষদের মাংস দেয়। রোজার ঈদে শাড়ি লুঙ্গী দেয়। সবাই যায়, রমিজ যায়না। জুলেখা মাঝে যেতে চায় কিন্তু রমিজ ক্ষেপে উঠলে থেমে যায়। যখন পাশের বাড়ির মাংসের সুগন্ধ ছোটে অথবা কারো পরনে দানের নতুন শাড়ি দেখে তখন রমিজের আড়ালে একা একা বকবক করে জুলেখা।


সেদিন শীতের সন্ধ্যায় মোংলা লঞ্চ ঘাটের একটা লঞ্চে উঠে বসে ময়না। জরাজীর্ণ ক্লান্ত শরীর নিয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়ে। অজান্তেই কখন ঘুমিয়ে গেছে নিজে জানেনা। মানুষের হইচই শুনে ঘুম ভাঙ্গে। অনেক আগের পরিচিত একটা ঘাটের নাম শুনেই তার শরীর কেঁপে ওঠে। সেই কতো বছর আগে লাল শাড়ি পরে স্বামীর সাথে এখানে নেমেছিল। গুটিসুটি পায়ে আজও নেমে পড়লো। এগিয়ে গেলো সেই পরিচিত গ্রামের পথ ধরে।


বেশ শীত পড়েছে। গ্রামের শীত একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। হাটতে হাটতে অজান্তেই ময়মা রমিজের বাড়ির সামনে এসে দাড়ায়। এক মনে চেয়ে আছে। মাথায় ছেড়া শাড়ির আঁচল একটু বেশি টানা। বারবাড়ি ঝাড়ু দিতে দিতে জুলেখার চোখ পড়ে ময়নার দিকে। মুখ খিচিয়ে বলে- কিডারে? এই তুমি কিডা? চোর নাকি?

ময়না তাড়াতাড়ি বলে না না আমি চোর না। নতুন আইছি। কাউরে চিনিনা। এক গ্লাস পানি দিবা?


ময়না রমিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিল। গায়ে শীতবস্ত্র বলতে একটা ছেড়া চাদর। ওর তেমন শীত লাগছেনা। আসলে উত্তেজনায় বোধ শক্তি হারিয়েছে বুঝি। সারাদিন খাবার বলতে পাড়ার দোকান থেকে দশ টাকার রুটি আর এক টুকরো গুড় খেয়েছে। আজ তার ক্ষুধাও লাগছেনা। সারাদিন গ্রামের পথে পথে হেঁটেছে। কাউকে সে চিনতে পারেনি। মাত্র পাঁচ মাস সে রমিজের বৌ ছিলো। তবে কলিমুদ্দিন শেখের কথা সে ভুলে যেতে পারেনি আজও। এতো বছরে তার অনেকবার দুঃস্বপ্নে দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে। এই মানুষটাকে সে রোজ কেয়ামতের ময়দানেও চিনতে পারবে। তার জীবনটা আজ পোকা মাকড়ের মতো হয়েছে তা শুধু কলিমুদ্দিনের জন্য। সে আজ এই গ্রামে কারো কাছে হাত পাতেনি। এই গ্রামে রমিজের বাড়ি। রমিজ তার স্বামী। এই জীবনে একমাত্র রমিজই তার স্বামী। সেদিন কলিমুদ্দিনের হিংসার স্বীকার না হলে সেতো আজ রমিজের বউ থাকতো। বুকের ভেতরটা হুহু করছে। জুলেখা রমিজের উঠোন, ঘর, বিছানা জুড়ে আছে। অথচ একদিন এখানে তার একমাত্র অধিকার ছিলো। মাত্র ক'মাস পরে রমিজ আর তার সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার কথা ছিলো।


আলো? থমকে যায় ময়না । সে কত বছর আলো দেখেনি? সেই যেদিন মিলিটারি এসেছিল সেদিন থেকেই আর আলো দেখা হয়নি।তার চারপাশে সবসময় ঘিরে থেকেছে গভীর অন্ধকার। সব আলোই মুছে গেছে তার জীবন থেকে। একাত্তরের নয় মাসের চেয়ে বানিশান্তা পতিতালয়ে অনেক সুখ ছিলো ময়নার। একাত্তর মনে হতেই জানোয়ারদের দেয়া যন্ত্রণায় শরীরটা এখনো কুঁকড়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন যায়গায় ব্যথা শুরু হয়। শরীর মনে কত ক্ষত জমে আছে কেউ জানেনা।


ময়না যুদ্ধর শেষের পনের দিন ছিলো এক পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে। অফিসার নাকি ছবি আঁকতে পারে।সেই অফিসারটা একদিন রাতে ময়নাকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুতে বলে। ময়না তাই করে, কারণ না করে কোন উপায় নাই। কয়েক মাস এদের সাথে থেকে ওদের ভাষা কিছুটা বুঝতে পারে তখন। অনেক অফিসারের চেয়ে এই লোক অনেকটা দয়াশীল। তবে সে দয়া অনেকটা ছাগলের জন্য বাঘের দয়ার মতোই। ভরা পেটে আক্রমণ করেনা কিন্তু খিদে পেলে ছিঁড়ে খায়। সে নাকি শিল্পিী, তাই একদিন ময়নার ছবি আঁকবে বলেছিলো।

জানোয়ারটা মাঝে মাঝে ময়নার শরীর থেঁতলে দিত। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি এতো নিষ্ঠুরতা কি করে দেখানো যায়? ময়না সেদিন মেঝেতে শুয়েছে দেখে শয়তানটা বিছানায় শোয়ার ইশারা করে। মাতালটা বিছানায় বসে ময়নার পিঠের কাপড় সরিয়ে ওর নগ্ন পিঠে হাত রাখে। প্রতিদিন নানাবিধ অত্যাচারে ফর্সা পিঠে নীল আর কালশিটে দাগে ভরে গেছে। আজ অফিসারের হাতটা বেশ মমতায় রেখেছে বলে মনে হচ্ছে। সেই লোক একটা কলম দিয়ে ওর পিঠে দাগ দিয়ে চলেছে। হঠাৎ সিগারেটের জ্বলন্ত মাথাটা কলমের মতো ঘুরাতে থাকে। ব্যথায় চিৎকার করছে ময়না। কিন্তু পাকি জানোয়ারের অট্টহাসির নীচে চাপা পড়ে যায় সব। অনেকদিন প্রচণ্ড যন্ত্রণা ছিলো তার পোড়া পিঠে। এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হলো। হাসপাতালে অনেকেই ওর পিঠের পোড়া দাগ দেখতে এসেছে। ওর পিঠে নাকি বাংলাদেশের ছবি এঁকে দিয়েছে সেই পাষণ্ডটা। আর তখন থেকেই বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা বীরাঙ্গনা ময়নার পিঠে।

এখনও ময়না ওর শরীরের সেই পোড়া দাগে যন্ত্রণা অনুভব করছে। সব মেনেছে তবে ফেলে যাওয়া সংসার তাকে সবসময় পিছু ডাকে। আজ অনেক কাছে এসেছিল ফেলে যাওয়া সংসারের। প্রিয় মানুষটার কণ্ঠস্বর শুনেছে কিন্তু কাছে যেতে পারেনি। দুরে কোথাও মাইকে মাননীয় সংসদ সদস্য কলিমউদ্দিন সাহেবের প্রশংসা চলছে। কানে যেতেই সে দিকে এগিয়ে চললো ময়না। কলিমুদ্দিন নামটা তাকে টানছে মঞ্চের দিকে। ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগুচ্ছে ময়না।

কলিমুদ্দিনকে একদিনই পুকুর পাড়ে দেখেছিল সে। আর যেদিন ধরা পড়লো সেদিন কিছুই দেখেনি ময়না কিছুই মনে নেই একমাত্র যন্ত্রণা ছাড়া। আঁতকে ওঠে ময়না আহ যন্ত্রণা, কত যন্ত্রণা এই শরীর জুড়ে।


ময়না মঞ্চের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মাইকে কেউ একজন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা কলিমুদ্দিন শেখের অবদান বর্ণনা করছে। চিৎকার করে বীর মুক্তিযোদ্ধা কলিমুদ্দিন শেখের অবদান বলে যাচ্ছে ছেলেটা। ভালো করে তাকায় ময়না তার ঝাপসা দৃষ্টি আর মাইকের বর্ণনায় কলিমুদ্দিনকে চিনতে দেরি হয়না তার। এবছরের ১৬ই ডিসেম্বর মাত্র একদিন পরে। বিজয় দিবস বা এর আনুষ্ঠানিকতা এতো কিছু ময়না বোঝেনা। ময়নাকে কেউ কখনো কোন কিছুতে ডাকেনি। ময়না বোঝে অশেষ যন্ত্রণার পরে একদিন কিছু মুক্তিযোদ্ধা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। তারপর আর কিছুই ফেরত পায়নি। কিন্তু কলিমুদ্দিনকে ময়না ঠিকই চিনেছে।


ময়না মঞ্চের সামনে এসে দাড়ায়। তাড়াতাড়ি কয়েকটা ছেলে তাকে মঞ্চের সামনে থেকে সরাতে চেষ্টা করে। ময়না তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ভীষণ জোরে চিৎকার করে বলে-সব মিথ্যা, সব মিথ্যা। হইচই পড়ে যায়। আরো ৩/৪ জন ছেলে এগিয়ে এসে ময়নাকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ময়না থামছেনা কিছুতেই। লোকজন জড় হয়ে যায়। ময়না বলে চলেছে,

-তোমরা জাননা সব মিথ্যা, সব মিথ্যা। কয়েকজন মুরুব্বী গোছের লোক বৃদ্ধ ময়নাকে এভাবে টেনে নিতে বাধা দেয়। একজন বলেন –তুমি ক্যামনে জান সব মিথ্যা? কিডা তুমি?

- আমি, আমি সবই জানি, আমারইতো সব জানা আছে।

ততক্ষণে হৈ চৈ এর জন্য সভা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকের ভিড়ে রমিজও একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

রমিজের দৃষ্টি বৃদ্ধা ভিখারির দিকে। ভেতরে ভেতরে একটু কাঁপছে সে।

হতভম্ব হয়েছে কলিমুদ্দিনও। আজকের বিপদের জন্য তার কোন প্রস্তুতি ছিলোনা। একটা সাপ সাপ শীতল ভয় তার ভেতরে কাজ করছে। আজকের অবস্থানে আসতে তার কম কষ্ট করতে হয়নি। স্বাধীনতার পরে প্রথম দিকে কিছুদিন তাকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে। তারপর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় করে ফেলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। বারবার পট পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে সে। আজ এক নষ্ঠা মেয়ে মানুষের জন্য সে সব হারাতে পারেনা। না না না তা কখনোই না।উত্তেজিত কলিমুদ্দিন একজনকে ইশারায় ডাকে। এক যুবক কাছে এসে দাড়ায় । কলিমুদ্দিন হিসহিস করে বলে,

-বাদল ঐ বেডি কি চায়? হের জন্য কি অনুষ্ঠান হইবোনা। তোরা কি করস। বেশ্যাডারে তাড়াতাড়ি খ্যাদা।

-জী দাদা। আমি অহনই খ্যাদাই। ছেলেটি বেশ তড়িৎ গতিতে চলে যায়।

ততক্ষণে ময়নার আশপাশে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। রমিজের বুকের ভেতরে ঢেঁকির পাড় দিচ্ছে।সংসারী মানুষ সে। বৌ ছেলেমেয়ে সব আছে, সাথে আছে অনেক অভাব। তবে কেউ একজন এখনো তার হৃদয় জুড়ে বসবাস করে।


যদিও ময়নাকে এখন আর মনে পড়েনা। তবুও অবসরে রাতের আধারে অথবা স্বপ্নে মাঝে মাঝে ময়না আসে তার কাছে। ভালোবাসে, সুখ দুঃখের কথা বলে, চোখ খুললে চলে যায়। আজ সেই একই রকমের কণ্ঠস্বর এই মহিলার। স্বপ্নটা কি সত্য হচ্ছে তার? না না তা কি করে হয়। এই মহিলা তার ময়না হতে পারেনা।রমিজ ময়নার পেছনে দাঁড়ানো। হঠাৎ বাদল নামের ছেলেটা ময়নার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। পড়ে যায় ময়না। আবার টান দিয়ে তোলে মুখ খিস্তি করে বলে-তুই যাবি নাকি গাঙ্গে ভাসায় দেব তোরে।

এতক্ষণ যারা ময়নার কথা শুনতে চাচ্ছিল তারা অসন্তুষ্ট হয় বাদলের এহেন আচরণে। কয়েকজন একসাথে প্রতিবাদ করে –হায় হায় এইটা কি করস। বুড়া মানুষ যা কইবার চায় কইয়া যাক। এইভাবে মারনডা ঠিকনা।

আজ ময়না নিজেকে বেশ শক্ত করে রেখেছে। তার অনাহারী দেহে যেন গায়েব থেকে শক্তি এসেছে। কয়েকটা কলেজ পড়ুয়া ছেলে এগিয়ে আসে, তাদের মধ্যে রমিজের ছোট ছেলেও আছে। ময়ন


দেহে যেন গায়েব থেকে শক্তি এসেছে। কয়েকটা কলেজ পড়ুয়া ছেলে এগিয়ে আসে, তাদের মধ্যে রমিজের ছোট ছেলেও আছে। ময়না বলছে-তোমরা আমারে চিনবার পার নাই। আমি এই গেরামের বৌ আছিলাম, ঐ কলিমুদ্দিন আমারে মিলিটারির হাতে তুইলা দিছিলো। সে একটা অমানুষ। সে কোনুদিন মুক্তিযুদ্ধ আছিলোনা।


ময়না চিৎকার করে সেই যুদ্ধ দিনের কথা বলছে।এখানে অনেকেই আছে সেদিনের জীবন্ত সাক্ষী। সবাই বাক রুদ্ধ। আর রমিজ সারা শরীরে অসহ্য কাঁপুনি নিয়ে কাঠের মতো দাড়িয়ে আছে।


এতো বাড়াবাড়ি মেনে নেয়া যায়না তাই মঞ্চ থেকে নেমে এসেছে কলিমুদ্দিন নিজেও। ভিড় ঠেলে ময়নার কাছে যাওয়ার জন্য বাদলের সাঙ্গরা কলিমুদ্দিনকে পথ করে দেয়। কলিমুদ্দিন এখন ময়নার মুখোমুখি।ময়নার চোখে আগুন সব পুড়িয়ে ফেলবে মনে হচ্ছ।প্রমাদ গোনে কলিমুদ্দিন, এখনই এই আগুন না নেভালে সব জ্বলে পুড়ে যাবে। তার এতো বছরের অর্জন সব নষ্টা হবে তার। হাতের লাঠি দিয়ে খুব জোরে ময়নার পেছন দিকে বাড়ি দেয় কলিমুদ্দিন। এই মার খাবার জোর ময়নার রোগ জরজরে শরীরে নাই । ঘুরে পড়ে যায় কলিমুদ্দিনের পায়ের কাছে। সবাই হা হা করে ওঠে। শেখ সাব কি করেন, কি করেন।


রমিজ শরীরে কিসের যেন তেজ অনুভব করে। ময়নার ছেড়া টুকরো কাপড়টা পিঠ থেকে কখন খসে গেছে কেউ খেয়াল করেনি। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ময়না কথা বলছেনা। কিন্তু কলিমুদ্দিনের রাগ কমছেনা। নিজের একটা পা ময়নার উদোম পিঠের উপরে রেখে বলে যা নষ্টা বেডিরে গাঙ্গে ফেলা। সারাদিনের অনাহার আর দুর্বলতায় জ্ঞান হারায় ময়না। রমিজের ছোট ছেলে প্রতিবাদ করে –না এইটা হইতে পারেনা। আমরা এই বুড়া মানুষের উপর আর অত্যাচার হইতে দিমুনা। কলিমুদ্দিনের পক্ষের একজন হাতে একটা হ্যাজাক বাতি মঞ্চের কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। কলিমুদ্দিনের পায়ের ধুলো রুমাল দিয়ে মুছে দিল একটা ছেলে। ধুলো সরাতেই দেখে ময়নার ফর্সা কুঁচকে যাওয়া চামড়ার পিঠে সিগারেটের আগুনে পোড়া পিঠে বাংলাদেশের মানচিত্রের ছবি এখনো স্পষ্ট। কলেজ পড়ুয়া ছেলেগুলো সহ সবাই কি বলবে খুঁজে পাচ্ছেনা।ময়নার কাছে এতক্ষণে এগিয়ে আসে রমিজ। ময়না ও ময়না কথা ক, আমারে ফালাইয়া কই গেছিলি। ময়না কথা বলেনা। হয়তো আর কোনদিনই কথা বলবেনা। স্থবির করে গেল কলেজ পড়ুয়া ছেলেগুলো।ওরা দেখলো ওদের সামনে কলিমুদ্দিনের জুতার নিচে পদদলিত হলো বাংলাদেশের মানচিত্র।


হঠাৎ গলার কাছ থেকে চাদরটা হাতে নিয়ে কলিমুদ্দিনের গলায় পেঁচিয়ে ধরে গর্জে ওঠে রমিজ-রাজাকারের বাচ্চা। আইজ তোরে শ্যাষ কইরা ছাড়ব। তুঁই আমার সংসার খাইছস, তুই আমার ময়নারে পাকিস্তানীর হাতে তুইলা দিছস, তুই গেরামের এ্যাত্ত গুলা মানুষ মাইরা মুক্তিযোদ্ধা হইছস।কলিমুদ্দিনের সাঙ্গপাঙ্গরা এগিয়ে এলে সাধারণ মানুষ আর ছাত্রদের প্রতিরোধে সরে য়ায়।


ময়নার দেহটা পড়ে আছে মাটিতে। রমিজের ছেলে ময়নার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলে-মা মা, একবার চাইয়া দেখ আমার বাজান তোমারে ডাকতাছে। রমিজ ময়নার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে। একটুখানি তাকায় ময়না। হয়তো সে ভালো করে রমিজকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্ত হলোনা। আস্তে মাথাটা ঢলে পড়ে।


পুলিশ এসে ময়নাকে হত্যা করা এবং ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য ধরে নিয়ে গেছে কলিমুদ্দিনকে। আর ময়নাকে রমিজের বাড়ির এক কোনায় কবর দেয়া হয়েছে। বড়ো কাঙ্ক্ষিত ছিলো তার কাছে এই ভিটা। সোখানে তার সংসার করা হয়নি কিন্তু স্থায়ী ঠাই হলো রমিজের বাড়িতে। হয়তো রমিজ মারা গেলে এখানেই তারও ঠাই হবে।এভাবেই কি পাশাপাশি হবে তারা?লক্ষ লক্ষ ময়না আর রমিজদের ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে সেখানে কলিমুদ্দিন রাজাকারেরা আর কতকাল এই দেশে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাবে??

17 views0 comments
bottom of page