top of page

কবি ও কবিতা: রুকসানা হক



প্রবারণা


দীঘল দৃষ্টি এঁকে এই মধু রাত্তিরে

ধুয়ে মুছে চাদঁটারে স্বভাবের দোষে

আমি ঘুরে আসি নদী রেললাইন পাশে রেখে

প্রবারণা দেখে দেখে মেঘ মন্দিরে ঢুকে

কবিতার ঘ্রাণ খুঁজি নিরবধি।

পাতাদের বাড়িঘরে কাড়ি কাড়ি পূর্ণিমা

হেঁটে গেছে ছাদবাড়ি চিবুকের কাছে

এঁকে আহাজারি ভুলসীমা।


জোছনায় ভিজে সেজে উত্তাল,

জোনাকি মেয়ের পাল

স্নান শেষে ভেজা পাতা মেলে ধরে তুঁত গাছ,

জবুথবু কামিনীর কচি কচি ফুল ডাল।

চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা নদীটির চোখ

আঁকে রাতের আকাশ

তারাগুলো থাকে ফুটে নদীজল হীরে খুঁটে

আলুথালু বাউরি বাতাস।


কার খোঁজে নেমে আসে

নীল ঘাসফুল মেখে ফুটপাতে অন্ধ বালক

ঘুমে তার স্বপ্নরা ধূসরিত ছন্দরা

ডানা ঝাড়ে আন্ধারে বুকের পালক

গৃহত্যাগি হলোসে কি, রেখে যেতে কোন দায়,

পূর্ণিমা ডলে ডলে ঘন নীল টিশার্ট ওড়ায়

তার সাথে উড়ে যাই স্বপ্ন লিরিকে ওড়াই

যত ব্যথা যতদুখ জীবন পোড়ায়।

 

হাবিলের বেদনার্ত কবর


এই তুমুল ঝড়বৃষ্টি কাঁপিয়ে তুলছে

হাইওয়ে, রিকশা মানুষ,

হরিতকির শাখা প্রশাখা,

দালানের কার্নিশে

লুকোনো যুগল চড়ুইয়ের সংসার।


ঝড় এলে বিগত সন্ধ্যাগুলো

পাপ ধুয়ে আঁচলটা জড়ায় গায়ে।

উল্টো হয়ে দাঁড়ানো বহুতল বাড়ি

বিষাদের সৌন্দর্যে ভাঙচুর হয়।

আমাদের থ্যাঁতলানো ফুসফুসে

সিগারেটের ধোঁয়ার মতন ঢুকে যায়

সৌন্দর্যের আর্তনাদ।


যে মা কন্যার লাশ

বুকে নিয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর

ঝড় এলে সেও জলে ভিজে

ঝাপসা হয় মানুষের চোখে।

আজকাল মানুষের চোখগুলো

নরকের দরোজায় ঝুলে থাকে

জলহীন জলের আত্মায় ঢুকে পড়ে

চাঁদের করুণ রক্ত।


কাবিলেরা বেঁচে থাকার মতবাদ নিয়ে

মঞ্চে উপবিষ্ট হয়।

ঝাঁঝালো কণ্ঠে উগরায় হাবিয়ার জাকাম।

মায়ের বুকে সেঁটে থাকা

মৃত কন্যার অমরত্ব উঠে আসে মঞ্চে।

কাবিলের শস্যক্ষেতে

মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তাজমহল।

ভেতরে উড়ন্ত আগুন।


এ আগুন নেভাতে

একটা প্রলয়ঙ্কারী ঝড় আসুক।

মঞ্চ ভেঙে পড়ুক রক্ত মিছিল শ্লোগানে।

ঝড়ের তান্ডবে

ওলট-পালট হোক লুটেরার করতল।

ভাঁটার মতন গনগনে রাগে ফুঁসে উঠুক

হাবিলের বেদনার্ত কবর।

 

সমুদ্রের ভোজ


তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা বাঁশবাগানের মতোই

পূণ্যস্পর্শী তোমার স্মৃতির অধ্যবসায়

শ্রাবণের মতোই নিরহংকারী, নির্মল মেঘ

কেটে গেলে আকাশে ছড়ায় লাল কমলার নির্যাস

ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে

গোধূলির সূর্য অলকানন্দার হলুদে মিশে যায়

গলে পড়া মাখনের আদলে।


শিল্পতত্ত্বের মতো জটিল প্রবাহিত সমুদ্র

তবু ঢেউভাঙা সন্ধ্যায় শুষে নেয়

তীরবিদ্ধ বাইসনের বেদনা

শাস্ত্রজটিলতা উপেক্ষা করে

জলের পুরোনো সিন্দুকে ঠাঁই নেয়

আকাশ আগুন

জীবন সারার্থের নিকটতম দূরত্বে

হাঁটু গেড়ে বসে থাকে পুরো অস্তকাল।


অমীমাংসিত কিছু প্রশ্ন নিয়ে

সমুদ্র বুকে রাত লিখে জোয়ারের জলে

নক্ষত্র আর আত্মা শুয়ে পড়ে

ইন্দ্রিয়াসক্ত জীবন নিয়ে

বক্ষলগ্ন রক্ত আঁকড়ে উচ্চারিত হয়

"আকাশের সব প্রেম হোক সমুদ্রের ভোজ উৎসব

তোমার সন্মানে।

 

রাতপাখির ধূসর কঙ্কাল


আবছা আলো-আঁধারি ভোর।

ঘুমভাঙা পাখিদের কলকাকলীতে

থৈথৈ চারপাশের গাণিতিক জীবন,

অমীমাংসিত অহং বেষ্টনী।

ধুকপুক আর্তনাদে পার হই স্মৃতির কুঁচবন।

বানের জলে কেউ যেন অতীত ঠেলে

ভেজানো হৃদয়ের কাছাকাছি তাঁবু খাটায়।

সামনে একফালি অন্ধকার,

আবছা সাদা রং কাফন সদৃশ মেঘেরা

ভর করে চোখের দুকূলে।


এমনি এক অন্ধকারে

কেউ করোটিতে অজস্র প্রশ্ন পিপাসা রেখে

গন্তব্যহীন পথ বেছে নেয়।

অথচ সে জানেনা পৃথিবীতে

দুঃস্বপ্নের চেয়ে বড় কোন প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই।


তার সাথে কবে কোন সন্ন্যাসী সন্ধ্যায়

বুঁদ হয়েছিলাম

আজ আর মনে করতে চাই না।

কিন্তু বিপুল ঈশ্বরের নির্ভুল অনুবাদে

ঊষার আকাশ হয় বেদনাদীর্ণ ঘুন্টিঘর।

তাঁকে এক পেয়ালা চায়ের উষ্ণতায় কিংবা

শাদা অফসেটে আর অর্ন্তজালে

দুঃখবিলাসী করে রেখেছি আমি।

ওইটুকুনই সারস্বত !


আমার অথর্ব ভাবনা ডোর

ক্ষুব্ধ করে ঘরোয়া অন্ধকারের প্রবাহ।

ধূলোর মৌচাকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা জোছনার

আর উঠে দাঁড়ানো হয় না

দুঃখবিলাসীর অনুদিত ছায়ায় ।

আমি তাকে মাড়িয়ে যাই মাথিনের কূপের দিকে।


দগ্ধ রাতের চোখ জুড়ে বসে থাকে

ভালবাসার বিবর্ণ ওম।

যে সময়টা আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে,

চলে গেছে স্বপ্নবাজের দখলে

তাকে একদিন আমিও পুষতাম

প্রিয় জানালার বর্ণিল কাঁচে।


এখন যন্ত্রণাগুলো পোষ মানাই কালির ধারায়

শব্দে শব্দে তাঁবুর পাশে।

ভেতরে ঢুকতে চাইনা।

কী জানি যদিএকদলা শূন্যতাকে শায়িত দেখি

তাহলে হয়তো আমার বেঁচেথাকা গুলো

ভ্যানগগের নীল তৃষ্ণা কিংবা

পিকাসোর ধূসর ক্লান্তি হয়ে যাবে।


এই ভিন্ন ভোরে ধ্যানমগ্ন হয়ে

মৃত্যুর অভিনয় করি,

এগিয়ে যাই গোরস্তানের নিরিবিলি

এপিটাফের দিকে।

শুনতে পাই এখানে কত সহস্র

সমুদ্রের ঝরানো বৃষ্টির গান।

এভাবে আমিও হয়তো একদিন

সব অভিনয় ভুলে সুরের আশ্রয়ে হবো

রাতপাখির ধূসর কঙ্কাল।

 

ছোঁয়াচে


আহ্ ! তোমার চোখের এই উৎসব,

এই অচঞ্চল বিস্ময় মুঠোয় নিয়ে ছুটছি মহাকাল

পথে কী ভীষণ ছোঁয়াচে আমাদের বেঁচে থাকার সৌন্দর্য

শীতকালীন বৃষ্টিতে বুক গলে ঝরছি

কুয়াশার আদলে তোমাকে

রেখেছি ভেজা পোশাকের মিহিন সুতোয়।


সাপলুডুর আল্পনায় আমরা ভাসছি

এই হুরশহরে তুমি শবাসনে শুয়ে থেকে

আমাকে রেখেছো তিনছক্কায়

আমি এই অভ্যস্থতায়

ছুটছি অন্তহীন বেলাভূমিতে।


তুলির স্পর্শ ছাড়াই আমাদের চিত্র

জাগছে সুরমূর্ছনায় উৎসবের বিপরীতে

আর কোন শব্দ নেই

তোমার চোখ এখন আমাকে প্রহরায়রত পদ্মগোখরো

যার ফণায় রয়েছে দুর্লভ মণি

মনকুঠুরীর গোপন কক্ষে

জ্বেলেছো দেহদীর্ণ চন্দ্রপ্রদীপ।


হলোই বা আমাদের এ যাত্রা সমাধির দিকে

বাঁশির সাতটি ফোঁড়ের যন্ত্রণায় সুর উঠে এলে

আমরাও পারি বনঘুঘুদের পালকে ভালবাসা লিখে

উৎসব ছড়িয়ে দিতে

তুমি তো জানোই ভালবাসার চেয়ে

আর কোন বড় উৎসব নেই।


76 views2 comments
bottom of page