top of page

শুভ জন্মদিনঃ কবি আতিকা হাসান



আতিকা হাসানের কবিতা



নারী ও জীবন


আতিকা হাসান

রহস্যময়ী রানী ক্লিওপেট্রা থেকে বস্তি গৃহের

আদরির মা

সহস্র বছরের ব্যবধান

সংখ্যাগত আধুনিকতা!

তবুও নারীত্বের দহন একইরকম

একইরকম প্রসব বেদনার শাশ্বত আড়ম্বর;

কে জানে এ প্রদাহের কতটুকু গভীরতা?

চোখের পাতায় নবজীবনের চিত্ৰ এঁকে

দরজার চৌকাঠ ডিঙায় যে জন

সময়ের খরতাপে পুড়তে থাকে প্রভাতের লালিত স্বপ্ন,

মুক্তডানার গতিময় পালক,

দেহেরভাজে জমা হয় ক্রমাগত ক্লান্তি আর নিঃস্ব অবসাদ।

ঠোঁটে -গালে উৎকট রংমাখা বিগ্রহের শরীর

চন্দন পালঙ্কের সুগন্ধি বিছানা অথবা

ঝোপের আড়াল ...

কেউ কী জানে এর কতটা ক্ষত; কতটা মদিরতা?

নারীর অস্তিত্বের একমাত্র ধূসর রং বদলায় না কখনো

বদলায়না জীবনবোধ;

তাইতো, ঠিকানাহারা বেহুলাদের ভাসতে হয় অতলজলে,

আগুনে ঝলসে সীতার পরীক্ষা হয় সতীত্বের,

শ্যাওলাপরা সমাধির দেয়ালে লেপ্টে থাকে আনারকলির হৃদয়ভেদী কান্না।


 

অভিমান


প্রভাতের শীতল স্নিগ্ধতায় জমা রেখেছিলাম কিছু সুগন্ধি আবেগ,

এক ফোটা তুষারপাত আর বিহঙ্গের মুক্ত আকাশ,

বসন্তের বরণডালায় উড়বে প্রজাপতি

সুরের মূর্ছনায় বিগলিত হবে নিঃসঙ্গ বাগান।

কিন্তু ঋতু বৈরিতার উত্থান চারদিকে

বিমূর্ত আত্মার দীর্ঘশ্বাস প্রান্তজুড়ে...।

গোধূলি বিকেলের একটুকরো পথ জমা রেখেছিলাম

হলুদ সন্ধ্যার আঁচলের ভাঁজে

রংধনুর রংমাখা জোড়া পদতলে বিধ্বস্ত হবে মোহময় বিকেল,

বিনিদ্র রজনী

কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি কখন যেন নিখোঁজ হয়েছে

গলে যাওয়া সূর্যের তপ্তজলে

নিখোঁজ-পোস্টারে ছেয়ে গেছে জলের শরীর।

করতলে জমা রেখেছিলাম এক চিলতে রোদ্দুর

জীবন অস্থিতে আলোর প্রদীপ জ্বালাবো বলে

হঠাৎ মুঠো খুলে দেখি ঘাম আর উত্তাপে

মুছে গেছে ভাগ্যরেখা,

তান্ত্রিক জ্যোতিষ তন্নতন্ন করে খুঁজেও পায়নি কোনো রেখার অস্তিত্ব,

বরং আবিষ্কৃত হয়েছে দহনের ধ্বংসস্তূপ,

রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড আর গলিত অস্থিমজ্জার কারখানা।

বার্ধক্যভারে জর্জরিত বৃক্ষটির বাকলের ছায়ায়

জমা রেখেছিলাম পুতুলের সংসার,

চড়ুইভাতির হাঁড়ি-পাতিল,

এক্কা-দোক্কা খেলার ঘুঁটি,

বেনারসি প্রেম আর কয়েক কলি ভাটিয়ালি সুর,

কিন্তু আজ হৃদয়ের গুদামঘরে শুধু এগুলোরই

বসবাস।

কখনো কখনো বুকের অতলান্ত ফুঁড়ে

তীব্র একাকীত্বের সঙ্গী হয় তারা,

উঁকি দেয় অতীত প্রতিবিম্ব

বিষণ্ণ হাসির অভিমান ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়

দৃষ্টির সীমানা... ।



 

আমি বাংলাদেশ


আমার গেরুয়া শরীরে প্রবাহমান

নানান জাতির রক্ত, বিমিশ্রিত ধর্মীয় প্রতীতি,

বৈচিত্র্যময় দেহে হাজার বছরের আর্য-অনার্য,

মোগল-পাঠান, মঙ্গোলিয়া, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান,

মুসলমান ও বিভিন্ন জাতির বাস,

মিলেমিশে আছে আমার চৌষট্টিটি মজবুত

হাড়ের বিন্যাসে।

আমাকে ছুঁয়ে থাকে ছয় ঋতুর শরীরের ঘ্রাণ

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকি অবলীলায়।

কত যুদ্ধ, কত দুর্যোগ, কত তীক্ষ্ণ নখরের

রক্তাক্ত থাবা ...

তবুও হার না মানা লড়াইয়ে বেঁচে থাকি

মাথা উঁচু করে।

আমার সন্তানের নাম যেমন শেখ মুজিব,

সেলিনা হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ

তেমনি মারিয়া কস্তা, দিপু বড়ুয়া, উমরা চাকমা,

মালিতা মারমা... আরো কত কী !

কুমোরপাড়ার পারুল রানী দাস, বিপ্লব দাস

ঘোষ বাড়ির শিল্পী ঘোষ, অরুণ ঘোষদের

আজও খুঁজে ফিরি গুমরে ওঠা হাহাকারে,

ঝরে পড়া জোছনা বেদনায়,

কোন এক অবাক ভোরে যারা হারিয়ে গিয়েছে

আমার গৃহকোণ খালি করে!

আমার হৃদয়ের কোণায় কোণায়

আজান আর উলুধ্বনির মূর্ছনা

গির্জার ঘণ্টাধ্বনির ঢং ঢং শব্দ।

আমি কখনো পুড়ি খরায়

কখনো ভাসি বন্যার জলে

কখনো কাঁদি রোগ-শোক-মহামারিতে।

কখনো কখনো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে দেখি

অজানা শত্রুর হিংসাত্মক তাণ্ডবলীলা,

বুকের গভীরে বহে কষ্টের রক্তক্ষরণ

দৃঢ়হাতে করি প্রতিরোধ।

আমার শীতল করতল গা ছুঁয়ে মাপে

সকল জাতির ভালোবাসার উত্তাপ

জড়িয়ে রাখি নিবিড় মমতায়,

শিরায় শিরায় মাটি ও শেকড়ের টান অশেষ

নিগূঢ় প্রেমের বন্ধন আমি;

আমি বাংলাদেশ।


 

আপন ঠিকানা


আতিকা হাসান

বিয়ের বছর দুই পর!

হঠাৎ একদিন...

আর্য ভূমির শেকড় হতে উপড়ানো হলো

সকল স্বপ্নবীজ

থেমে গেল জয়িতার জীবন সংসার

আঁচলচাবির পুরানো লেনদেন

ক্লান্ত পদযুগল আবারো ফিরলো

জন্ম গৃহকোণে।

কিন্তু অবাক বিস্ময় ছুঁয়ে গেল তার চোখের পাতা,

যে ঘর ছিল ভালোবাসার আশ্রয়

অসীম ক্লান্তির শীতল ধারা

সে ঘর এখন-

পরাজয় আর লজ্জার খড়কুটোয় ছাওয়া;

সহস্র পোকামাকড়, খানাখন্দ আর উঁচুনিচু

উঠানামা।

অসংখ্যবার শোনা কাহিনী হৃদয়ে বাজে আবার,

বারান্দায় শোয়ানো একমাসের ছোট্ট শিশুর

উপর ধসে পড়েছিল আশিমন পাটের হাতা,

পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে বাবা খুঁজে পেয়েছিলেন অতি আদরের ধন,

বুকের ভেতর আগলে রেখেছিলেন তারপর

কোনো আঁচড় লাগতে দেননি আর।

আজ বাবা নেই-

সম্পূর্ণ পৃথিবীর ভার ধসে পড়েছে জয়িতার

মাথার উপর,

কুঁকড়ে গেছে দেহ পাঁজর

থেমে গেছে অকারণ হাসির দমক।

তালাবন্ধ খাঁচায় বন্দী পাখির মতন

ঝিমুতে ঝিমুতে কেটে গেছে বহু বিনিদ্র প্রহর,

বহু দিনরাত।

তবুও হাতড়িয়ে বেড়ায় বারবার

খুঁজে ফেরে আপন ঠিকানা।

সময়ের চাকা বেয়ে...

আহা মেয়ে!

কবে তোমার একটা নিজ ঘর হবে?

আপন ঠিকানায় কবে থাকবে মাথা উঁচু করে?

কবে নেবে শ্বাস, প্রাণভরে?

খুঁজে পাবে সিঁদুরহীন বাঁচার মহিমা!


 

জয়িতার গন্তব্যে ফেরা


এক বিরামহীন তিতকুটে ভ্রমণের পর

হঠাৎ জয়িতার গন্তব্যে ফেরা,

বিষাদময় জীবনের সফরনামার পরিসমাপ্তি

বর্ণহীন গল্পের সাদামাটা উপসংহার।


ক্লান্তিকর পদযুগল আর দাঁড়াবেনা

ব্যস্ত নগরের ফুটপাতে

ঘুমন্তচোখ রাতের গা ছুঁয়ে খুঁজবেনা সময়ের হিসাব

ছদ্মবেশী অন্ধকার চেপে ধরবেনা কণ্ঠনালী

থেমে যাবে দিনরাতের ছোটাছুটি

একই কাজের গ্লানিকর পুনরাবৃত্তি।

অস্থির মনের যন্ত্রণার বিলাপ আর ভাসবেনা বার্তা ,

প্রতিটি শব্দের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো রবেনা

গভীর আবেগের নরমস্পর্শ

হৃদয় খুঁজবেনা ভালোবাসার ব্যাকরণ

নীরব চাওয়ার আত্মকথন।


অচলমুদ্রা নতুন রূপে পরিবর্তন হয়ে

একলা মানুষ পুনরায় একলা হয়ে

জয়িতা পৌঁছুবে পরিপূর্ণ স্তব্ধতায়

প্রগাঢ় শান্তির নিবিড় নির্জনতায়।

কিন্তু জগৎ সংসারে রয়ে যাবে তার

শত দুঃখের দাগ

বারান্দায় ঝুলবে নিত্যদহনের

অশ্রুমোছা গায়ের কাপড়

পোষা ময়নার খাঁচায় শুকাবে কয়েকটি খাদ্যকণা

আর টেবিলের কোণায় অভিমানে ঠাণ্ডা হবে

ধোঁয়াওঠা এক কাপ গরম চা।

 

বদ্ধডোবার জলজঘ্রাণ


জীবনের সাথে লড়তে লড়তে বিলুপ্ত হয়েছে অস্তিত্ব

বিলুপ্ত হয়েছে স্বপ্নের পরিধি, ঘুমন্ত দুপুর আর বিকেলের বাহারি রোদ

পেটের দায় যখন ভর করে মাটির টুকরি,

ফেরি করা সবজির ঝুড়ি অথবা ইটভাঙা হাতুড়ি-

পুরো পৃথিবীর ছাদ ধসে পড়ে মাথার উপর,

তীব্র ব্যথায় তখন ককিয়ে ওঠে সমস্ত শরীর।

নিজের ওজনের চেয়ে বেশি ভার বইতে বইতে

চৌচির হয়েছে দেহের হাড়

পায়ের গোড়ালি

প্রণয়ের আদ্র জমিন,

বিনা বজ্রপাতে চামড়া পুড়ে ছারখার।

প্রখররোদ গিলে খেয়েছে রূপের জৌলুস

নারীত্বের স্বাভাবিক সৌন্দর্য আর

অহংকারী যৌবন;

চিপা কানাগলির নীলজলে ডুবন্ত মাছি তবুও

সুযোগ পেলে টেনে ধরে শাড়ির আঁচল; ঘৃণা নয়

ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয় এক চিলতে অবজ্ঞার হাসি…

আহা! আমিও কী তবে নারী?


কলুর বলদের ন্যায় নিত্য বয়ে বেড়াই জীবনের ঘানি

বয়ে বেড়াই চোখের কোণে নোনাপানিকাব্য

পাঁজর ভাঙা ব্যথার স্রোত নিরন্তর জেগে থাকে শিথানে, বালিশে,

অঝোর বৃষ্টির পলিময় জলধারা কখনো স্পর্শ করেনা

শুকনো জমিনের বীজতলা

তাইতো বদ্ধডোবার জলজঘ্রাণে পদ্মও ফোটেনা!


24 views0 comments
bottom of page